কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম উত্তর হাওলার বাসিন্দা মো. শাহজাহানের বয়স ষাটের কাছাকাছি। বেশ কয়েকটি বড় বন্যা দেখেছেন। তবে এবারের বন্যাকে স্মরণকালের ভয়াবহ হিসেবেই মনে রাখতে চান বন্যাকবলিত গ্রামটির এই বাসিন্দা। কারণ হিসেবে অতীতে এমন বানের পানি কখনোই দেখেননি বলে জানান তিনি।
মো. শাহজাহানের ভাষ্য, অতীতে বন্যা হয়েছে, আবার কয়েক দিন পর পানি নেমে গেছে। কিন্তু এবার প্রায় দেড় মাস হলেও বন্যার পানি সেভাবে নামছে না। এতে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মনোহরগঞ্জের অন্তত ১০টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, শাহজাহানের মতোই দুর্ভোগ ও কষ্টে আছেন শত শত পানিবন্দী মানুষ। এখনো অনেক সড়ক পানির নিচে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এমন পরিস্থিতিতে সেখানে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
এবারের বন্যায় কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪টিতেই পরিস্থিতি খুব খারাপ ছিল। তবে অন্যান্য উপজেলার তুলনায় মনোহরগঞ্জের বন্যার পানি এখনো তেমন নামেনি। দেড় মাস পরও উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী।
কুমিল্লা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, অবাধে নদী, খাল ও জলাশয় দখল-ভরাটের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খাল দখল ও ভরাটের কারণে পানি চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ায় বন্যার পানি দ্রুত নামতে পারছে না।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জমে থাকা বন্যার পানি রূপ নিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতায়। এতে চরম দুর্ভোগে রয়েছেন বাসিন্দারা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, মনোহরগঞ্জে এখনো ৭০ শতাংশ গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে রয়েছে। মনোহরগঞ্জ ছাড়া পাশের লাকসাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলার দক্ষিণের কয়েকটি স্থানেও বানের পানি সেভাবে নামতে না পারায় এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
কুমিল্লা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, অবাধে নদী, খাল ও জলাশয় দখল-ভরাটের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খাল দখল ও ভরাটের কারণে পানি চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ায় বন্যার পানি দ্রুত নামতে পারছে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজালা রানী চাকমা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদী-খালে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকারের কারণে পানি নামতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমরা যেখানেই খবর পাচ্ছি, সেখানেই নদী-খালের বাঁধ অপসারণে অভিযান চালাচ্ছি। পানি কেন কমছে না, তা খতিয়ে দেখতে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।’
উপজেলার খিলা ইউনিয়নের সাতেশ্বর গ্রামের হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ এখনো পানিবন্দী। দেড় মাসেও পানি নামেনি। আরও কত দিন এ দুর্ভোগের মধ্যে থাকতে হয় জানি না।’
কাটুনিপাড়া গ্রামে এখনো নৌকা ছাড়া চলাচলের কোনো উপায় নেই। ওই গ্রামের বাসিন্দা ইহসাক মজুমদার বলেন, পানি কিছুটা কমে, আবার বৃষ্টি হলে বেড়ে যায়। এখন যে পানি আছে, তা কমছে না।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বন্যার পানি দ্রুত নামতে না পারার কারণ হিসেবে কয়েকটি তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের ভাষ্য, এই উপজেলা থেকে বন্যার পানি দুইভাবে নামার কথা। একটি ডাকাতিয়া নদী। বর্তমানে নদীর বেশির ভাগ এলাকা কচুরিপানায় ভর্তি। নদীর প্রধান শাখা খালগুলোরও একই অবস্থা।
নদী-খালে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকারের কারণে পানি নামতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমরা যেখানেই খবর পাচ্ছি, সেখানেই নদী-খালের বাঁধ অপসারণে অভিযান চালাচ্ছি। পানি কেন কমছে না, তা খতিয়ে দেখতে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছেমনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজালা রানী চাকমা
পানি নামার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ডাকাতিয়া নদীর নদনা খালের মুখে নির্মিত স্লুইসগেট। কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রায় দুটি কোটি টাকা ব্যয়ে গেটটি নির্মাণ করে; কিন্তু নির্মাণের পর থেকে এটির আর মেরামত বা সংস্কার করা হয়নি। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরের বছরই সেটি অকেজো হয়ে পড়ে। গেটটি এখন মানুষের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ছাড়া বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ও প্রভাবশালীরা ডাকাতিয়া নদী ও নদীর শাখা খালগুলো দখল করেছেন। গ্রামীণ ছোট-বড় খালগুলোও প্রভাবশালীরা দখল–ভরাট করেছেন। অনেক স্থানে খালের মধ্যে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। এসব কারণে এ উপজেলায় বন্যার পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
মূলত পানি নামার পথগুলো বন্ধ বা সংকুচিত হয়ে পড়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। খাল দখল ও ভরাট যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াসহ পানি নামার পথ আগের মতো সৃষ্টি করতে হবে। এটা না করা গেলে দ্রুত এসব সমস্যা সমাধান হবে না।পাউবো কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান
মনোহরগঞ্জের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের পানি আগে বেরুলা খাল দিয়ে নিষ্কাশিত হতো। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই খালের বড় অংশ ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। খালটির অন্যান্য অংশ দখল ও ভরাট করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে বন্যার পানি নামতে পারছে না।
জানতে চাইলে পাউবো কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মূলত পানি নামার পথগুলো বন্ধ বা সংকুচিত হয়ে পড়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। খাল দখল ও ভরাট যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়াসহ পানি নামার পথ আগের মতো সৃষ্টি করতে হবে। এটা না করা গেলে দ্রুত এসব সমস্যা সমাধান হবে না।