নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ধানখেতে পাওয়া ‘অবিস্ফোরিত’ মর্টার শেল। শুক্রবার তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্ত সড়কের পশ্চিমকুল এলাকায়
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ধানখেতে পাওয়া ‘অবিস্ফোরিত’ মর্টার শেল। শুক্রবার তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্ত সড়কের পশ্চিমকুল এলাকায়

একের পর এক অবিস্ফোরিত মর্টার শেল পাওয়ায় সীমান্তে আতঙ্ক

সকালে উঠে বাড়ির পাশের সবজিখেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন গৃহবধূ হালিমা বেগম। সেখানে কুড়িয়ে পাওয়া ‘একটি ধাতব বস্তু’ হাতে করে ঘরে নিয়ে আসেন তিনি। প্রতিবেশীরা দেখে জানান, বস্তুটি ‘অবিস্ফোরিত মর্টার শেল’। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘর থেকে সেটি পাশের সড়কের ওপরে রেখে আসেন।

আজ শনিবার সকালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা পশ্চিমকূল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গত তিন দিনে এই সীমান্ত এলাকার বসতবাড়ির উঠান ও ফসলের খেত থেকে এমন তিনটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল পাওয়া যায়। এ ছাড়া বসতঘর, উঠান, সড়ক ও বিলে পাওয়া যাচ্ছে গুলি ও গুলির খোসা।

সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া ও তুমব্রু সীমান্তচৌকি ঘিরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) মধ্যে সংঘর্ষ থামলেও একের পর এক গুলি ও মর্টার শেল উদ্ধারের ঘটনায় এপারের লোকালয়ে আতঙ্ক কমছে না।

গত সোমবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। পরে স্থানীয় লোকজন মর্টার শেলটির কয়েকটি অংশ কুড়িয়ে পান। পরদিন মঙ্গলবার সকালে মধ্যমপাড়া এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বসতবাড়ির উঠানে এসে পড়ে আরেকটি মর্টার শেল। এতে ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার বসতঘরের কাচ ভেঙে যায়।

গত বৃহস্পতিবার থেকে আজ সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ঘুমধুমের সবজি ও ধানখেতে কুড়িয়ে পাওয়া যায় আরও তিনটি মর্টার শেল। শুধু ঘুমধুম নয়, পাশের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ও টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায় মঙ্গলবার থেকে একের পর এক গুলি পাওয়া যাচ্ছে।

বান্দরবানের নাইক্ষংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে পাওয়া মর্টার শেলটি তুমব্রু সড়কে রাখা হয়েছে। আজ শনিবার সকাল ৯টায়

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘর্ষের গুলি ও মর্টার শেল এপারের লোকালয়ে এসে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এসব কুড়িয়ে নিয়ে বিজিবি সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করছেন। কিছু কিছু গুলি ও বিস্ফোরিত মর্টার শেল নিয়ে শিশুদের খেলতে দেখা গেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ঘুমধুম ইউনিয়নের নয়াপাড়া বিলে একটি মর্টার শেল কুড়িয়ে পায় শিশুরা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শিশুরা শেলটি বস্তায় ভরে বসতবাড়ির কাছে নিয়ে আসে। এলাকার লোকজন মর্টার শেলটি দেখে ধারণা করেন যে এটি অবিস্ফোরিত। পরে খবর পেয়ে বিজিবির সদস্যেরা সেটি তাঁদের হেফাজতে নেন।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি বৃষ্টির মতো গুলি এপারে এসে পড়েছিল। সেসব স্থানীয় বাসিন্দারা কুড়িয়ে যেদিকে পেরেছেন, নিয়ে গেছেন। তবে তাঁরা খবর পেলেই এসব বিজিবির কাছে হস্তান্তর করছেন।

আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, বিজিবির তুমব্রু বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) এলাকায় সড়কের ওপর একটি মর্টার শেল পড়ে রয়েছে। চারপাশে লাল পতাকা পুঁতে দিয়ে এবং সড়কের ওপর বাঁশ ফেলে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই এলাকা থেকে ওপারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দেখা যায়। ওই ক্যাম্প বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মি দখল করে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, ওপারের সীমান্তচৌকিগুলো এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির দখলে। সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সংঘর্ষে ঠিকতে না পেরে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় সংঘর্ষ থেমে গেছে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর সীমান্তঘেঁষা এলাকার কৃষকেরা খেত-খামারে যাচ্ছেন। সেখানে একের পর এক মর্টার শেল পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া শত শত গুলি ও গুলির খোসা পাওয়া যাচ্ছে বসতঘরের চালে, উঠানে, খেতে।

মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল এসে পড়ে বাংলাদেশের একটি বাড়ির উঠানে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্যমপাড়া এলাকায়

এদিকে আজ ভোরে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কোনাপাড়া ও মাঝেরপাড়া এলাকার তিনটি বসতঘরে তিনটি গুলি পাওয়া গেছে। সীমান্তের ওপারে কুমিরখালী সীমান্তচৌকি ঘিরে আজ গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় কিছু গুলি এপারের লোকালয়ে মানুষের বসতঘরে পড়ে। স্থানীয় মাঝেরপাড়ার নুরুল আবছার বলেন, তাঁর বসতঘরেরর জানালা ছিদ্র করে ঘরের ভেতরে ঢোকে একটি গুলি। ঘরের টিনের চাল ছিদ্র হয়ে মোহাম্মদ মানিকের ঘরে একটি ও পাশের জমিতে আরেকটি গুলি পাওয়া গেছে।

উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সংঘর্ষের মধ্যে মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমারের ২৩ নাগরিক বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তাঁদের হাতে অস্ত্র, গুলি ও হাতবোমা ছিল। পরে তাঁদের আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। গতকাল শুক্রবার তাঁদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা হয়।

এ বিষয়ে বিজিবির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অবিস্ফোরিত মর্টার শেলগুলো নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে। যেসব গুলি ও বিস্ফোরিত মর্টার শেল পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো ক্যাম্পে রেখে দেওয়া হচ্ছে।