বিফলে যায়নি আফাজ কবিরাজের চেষ্টা 

আফাজ উদ্দিনের ঔষধি গাছের চাষাবাদ নিয়ে ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ‘নাটোরের ঔষধি গ্রাম’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই বছর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক আফাজকে সংবর্ধনা দেয়।

লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামজুড়ে এখন ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়।

১৮ বছর আগে খোলাবাড়িয়া গ্রামে ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেছিলেন কবিরাজ আফাজ উদ্দিন। সারা দেশের মানুষ ধীরে ধীরে নাটোর সদর উপজেলার এ গ্রামকে ‘ঔষধি গ্রাম’ বলে জানতে শুরু করে। ২০০৪ সালের এক অনুষ্ঠানে আফাজ উদ্দিন বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্ন, এখানকার গাছগাছড়া বিমানে করে একদিন বিদেশে যাবে।’ চার বছর আগে আফাজ উদ্দিন মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, আগে খোলাবাড়িয়া গ্রামের উৎপাদিত গাছগাছড়া শহরের ফুটপাতে বা গ্রামের হাটবাজারে বিক্রি হতো। বর্তমানে এ এলাকায় উৎপাদিত গাছ তাইওয়ান, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া শতাধিক প্রতিষ্ঠান এখানকার গাছগাছড়া থেকে ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরি করে রপ্তানি করছে।

নাটোর শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামজুড়ে এখন ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়। ১১ নভেম্বর দুপুরে খোলাবাড়িয়া গ্রামের আমিরগঞ্জ, ইব্রাহিমপুর, খোলাবাড়িয়া, হাজীগঞ্জ ও গাবতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সবুজ গাছপালায় ঘেরা গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটি পাকা সড়ক। সড়কের দুই পাশে চোখে পড়ে ঘৃতকাঞ্চন, শিমুলমূল, মিছরিদানা ও রোজেলার খেত। প্রতিটি বাড়িতে কমবেশি ভেষজ গাছ রয়েছে। 

 জয়নাল আবেদিন নামের এক উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন ভেষজ গাছের এক সংগ্রহশালা। সেখানে ৫৬০ প্রজাতির ভেষজ চারা রয়েছে। নতুন বাজারের পাশে শহিদুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন রোজেলার বাগান। 

গ্রামটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আফাজ উদ্দিনের বাড়ি। তাঁর স্ত্রী হেলেনা বেগম বলেন, ‘পাগলের (আফাজ) ভক্তরা ভালোবাসি তাঁর কবর লালসালু দিয়া ঢাকি দিছে। বাঁচি থাকতে পাকা ঘরে ঘুমাতে পারিনি। এখন ছাদয়ালা পাকা ঘরে ঘুমাচ্ছে। ঔষধি গ্রাম করে তাঁর এটায় লাভ হয়ছে।’

তাইওয়ান ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঘৃতকাঞ্চন প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে।

পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আফাজ উদ্দিনের ঔষধি গাছের চাষাবাদ নিয়ে ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘নাটোরের ঔষধি গ্রাম’ শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই বছরের ৯ মার্চ রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক অনুষ্ঠান করে আফাজকে সংবর্ধনা দেয়। ভেষজ চাষিদের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে। ওই অনুষ্ঠানেই আফাজ উদ্দিন আশা প্রকাশ করেছিলেন, গ্রামের ভেষজ গাছগাছড়া একদিন বিদেশে রপ্তানি হবে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, কয়েক বছর ধরে এ গ্রামে যা ঘটছে, তা আফাজ উদ্দিনের স্বপ্নের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। তাইওয়ান ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে গ্রামে উৎপাদিত ঘৃতকাঞ্চন (অ্যালোভেরা) প্রক্রিয়াজাত করে তাইওয়ান, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। শুধু এই একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিন প্রয়োজন পড়ে ২০ থেকে ২৫ মেট্রিক টন ঘৃতকাঞ্চন। এ ছাড়া স্কয়ার, এক্‌মি, হামদর্দসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান এখানকার গাছগাছড়া থেকে ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরি করে রপ্তানি করছে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, স্থানীয়ভাবে ঔষধি গাছগাছড়ার বাজারও বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে। গত দেড় যুগে এখানে নতুন করে শতাধিক ঔষধি পণ্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সে সময় গ্রামে প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো কারখানা ছিল না, এখন আছে সাতটি কারখানা। এসব কারখানায় শতাধিক প্রজাতির গাছগাছড়া প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। গড়ে উঠেছে অর্ধশত আড়ত ও পাইকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এমনকি নতুন বাজার নামে একটি ওষধি বাজারও গড়ে উঠেছে। ওই বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ঔষধি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি। সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও ব্যাংকও তাঁদের ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগান দিচ্ছে।

সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রীও গ্রামটি পরিদর্শন করেছেন বলে জানালেন জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, দেশের একমাত্র ঔষধি গাছের গ্রাম নাটোর। এখানকার চাষিরা কম জমিতে ভেষজ চাষাবাদ করে অন্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। তাই এর উৎপাদন ও ব্যবসা সম্প্রসারণ হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ এখানকার চাষিদের পাশে থেকে নানা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন।

খোলাবাড়িয়া গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই যুগ আগে এই গ্রামে শুধু বাড়ির আঙিনা ও আবাদি জমির আইলে ঔষধি গাছ চোখে পড়ত। এখন দৃশ্য পাল্টেছে। ধান-পাটের মতো বড় বড় জমিতে ঘৃতকাঞ্চন, শিমুলমূল, মিছরিদানা, রোজেলা, আলকুশি, অশ্বগন্ধা ও শতমূলের খেত চোখে পড়ে। চাহিদার পাশাপাশি প্রতিবছর চাষাবাদও বেড়ে চলেছে। এখানকার চাষি ও ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছেন। দোকানে দোকানে ইন্টারনেট সুবিধা, অনলাইন আদান–প্রদান ও প্রচার এখন নিত্যদিনের ঘটনা। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ অনলাইনে যুক্ত হয়ে রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় গাছগাছড়া কুরিয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের হাতে।

গ্রাম থেকে ফেরার সময় আমিরগঞ্জ বাজারে ঢুকে চোখে পড়ে, বাজারের ৫৬টি দোকানের ৫১টিই ভেষজ গাছগাছড়ার। এর একটির নাম ‘ভেষজ বাড়ি।’ ভেতরে ঔষধি গাছগাছড়াভর্তি সারি সারি প্লাস্টিকের পাত্র। পাত্রের গায়ে গাছের নাম লেখা। ১০ মিনিট ধরে পড়েও নামগুলো পড়ে শেষ করা গেল না। দোকানমালিকের সামনের টেবিলে ল্যাপটপের পাশে রাখা কার্ডে লেখা আছে দোকানের ওয়েবসাইট, ই-মেইল, ফেসবুক ও ইউটিউব আইডি। মাথার ওপর ঝুলছে ইন্টারনেটের মডেম। 

দোকানি মোস্তফা কামাল বলেন, তিনি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এ ব্যবসায়। তাঁর মতো আরও অনেকে আছেন, যাঁদের বিনিয়োগ অনেক। তবে করোনাকালে বেচা-বিক্রি বন্ধ থাকায় তাঁরা ও চাষিরা অনেক লোকসানে পড়েছেন। এখন তাঁরা সে লোকসান পোষানোর চেষ্টা করছেন।