চট্টগ্রামে নগর পরিকল্পনা বিষয়ে বক্তব্য দেন পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। আজ বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের সম্মেলনকক্ষে
চট্টগ্রামে  নগর পরিকল্পনা বিষয়ে বক্তব্য দেন পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। আজ বিকেলে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের সম্মেলনকক্ষে

‘উন্নয়ন নয়, সরকারের আগ্রহ ছিল টাকা খরচে’

চট্টগ্রাম নগরে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে পরিকল্পনা ছাড়া। উড়ালসড়ক ও টানেল তৈরিতে পরিকল্পনায় যত না নজর ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ ছিল টাকা খরচ করায়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের উদ্যোগে ‘সমগ্র দেশের পরিকল্পনা করি, বৈষম্যহীন সুষম বাংলাদেশ গড়ি’ শিরোনামে আজ শনিবার বিকেলে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। নগরের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত সেমিনারে নগর–পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, পরিবহনবিশেষজ্ঞ, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ অংশ নেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান অপরিকল্পিত উন্নয়নের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চট্টগ্রামকে এশিয়ার অন্যতম স্বাস্থ্যকর শহর বলা হতো। এই শহরে গত ২০ থেকে ৩০ বছরে উন্নয়নের নামে কম টাকা খরচ করা হয়নি। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়েছে।

কিন্তু এত ব্যয় করার পরও পত্রিকার পাতাগুলোয় নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে অপরিকল্পিতভাবে উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। টানেল নির্মাণে পরিকল্পনার চেয়ে অর্থ খরচের আগ্রহ ছিল বেশি।

অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, যারা পাহাড় কাটছে, খাল দখল করছে; তাদের চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত করতে না পারলে পাহাড় কাটা বন্ধ হবে না। দখলদারদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে।

খেলার মাঠ, পার্ক, জলাধার রক্ষা করার দাবি জানিয়ে অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এসব রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। এখনো চট্টগ্রামকে বাঁচানো সম্ভব। এ জন্য মহাপরিকল্পনা তৈরির সময় মতামত নিতে হবে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় আপস করা যাবে না।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘এত দিন ধরে চট্টগ্রাম শহরে যে কাজগুলো হয়েছে, সেগুলোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পরিকল্পনা করতে নগর সরকারব্যবস্থা দরকার। এই ব্যবস্থা থাকলে আমরা পরিকল্পিতভাবে শহরটা গড়ে তুলতে পারতাম। বিভিন্ন কারণে নগর সরকারের ধারণাটি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক শহরে এই ধারণাটি রয়েছে।’

শাহাদাত হোসেন বলেন, ৭০ থেকে ৭৫ লাখ মানুষ এই শহরে বসবাস করে। এই শহর যতটা বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। ১৯৯৫ সালে ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা হয়েছিল। সেটি মেনে কাজ হয়নি। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও গড়ে ওঠেনি। এখন সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

শহরের পার্কগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মেয়র শাহাদাত হোসেন। তিনি এ বিষয়ে বলেন, সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে পার্কগুলো সংস্কার করা হবে। ইতিমধ্যে বিপ্লব উদ্যানের বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢেবার পাড় এলাকাটিও সাজানো যাবে। পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শে এ রকম আরও নানা উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সেমিনারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. নুরুল করিম বলেন, ‘আমরা এ শহরে অনেক কিছু করেছি। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছি। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। চট্টগ্রাম শহরের জন্য যে মহাপরিকল্পনা হচ্ছে, সেটি পেশাজীবীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। এতে সবার মতামত জানা যাবে।

চট্টগ্রামকে বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সেমিনারে নানা পরামর্শ দেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার। তিনি বলেন, ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করে ও ভবিষ্যৎ নিরাপদ রেখে বর্তমানের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। শারীরিকভাবে সক্ষম বা অক্ষম ব্যক্তিটিও যাতে নগরে তৃপ্তি নিয়ে বসবাস করতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি নগরবাসীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নজর দিতে হবে। বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দেলোয়ার মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামকে অন্য কোনো শহরের মতো নয়, এই শহরের জনসংখ্যা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

এমন একটা চট্টগ্রাম নগর হতে হবে, যেখানে কোনো কিশোরী মেয়ে দিন–রাতের যেকোনো সময় নিরাপদে বাইরে বের হতে পারবে, যেখানে প্রয়োজন সেখানে যেতে পারবে—সেমিনারে এই মন্তব্য করেন প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। তিনি বলেন, এ রকম শহর হলেই সেটি বাসযোগ্য হবে।

সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান দেবাশীষ রায় রাজা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপপ্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী প্রমুখ।