রাজশাহী শহরের পাকা রাস্তা ধরে এক পাল গরু নিয়ে পেছনে পেছনে হাঁটছিলেন এক ব্যক্তি। হাতে লাঠি। গরুগুলো এদিক–সেদিক গেলে নানা আওয়াজে সেগুলোকে পথে রাখেন তিনি। বছরের ছয় মাস গরুগুলোকে পদ্মা নদীর চরে নিয়ে যান। তবে শীত ও বর্ষার সময়টায় শহরের আনাচকানাচে গরু নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় তাঁকে।
এই ব্যক্তির নাম ইব্রাহীম খলিল (৫৫)। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌর এলাকার শ্যামপুর দক্ষিণপাড়া পদ্মা নদীর ধারে। জীবনের দীর্ঘ একটা বড় সময় ধরে তিনি গরু লালন–পালনের সঙ্গে নিয়োজিত। তিনি বললেন, বছরের ছয় মাস গরুগুলো পালতে খুব কষ্ট হয়। আর বাকি ছয় মাস পদ্মার চরেই থাকে গরুগুলো।
রাজশাহী শহরের দক্ষিণ পাশ দিয়েই প্রবহমান পদ্মা নদী। নদীর অভ্যন্তরে আছে কয়েকটি চর। এই চরগুলো ৫-১০ বছর পর্যন্ত থাকে। আবার একটি চর ভেঙে আরেকটি চর জেগে ওঠে। নদীর আশপাশের মানুষগুলো জেগে ওঠা এসব চরে চাষাবাদ করেন। তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এই বিশাল চরে গরু চরানো যায়। এ কারণে পদ্মাপাড়ের মানুষদের মধ্যে গরু পালার প্রবণতা বেশি।
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পদ্মা নদী উপচে চরে পানি উঠে যায়। তখন চর থেকে গরু লোকালয়ে নিয়ে আসতে হয়। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরে কিছুদিন গরু চরানো যায়। এরপরই ঘাস মরে যায়। অর্থাৎ বাকি সময়গুলো গরুগুলোকে আর চরে নেওয়া যায় না। এ সময়ে গরুগুলোকে লোকালয়ে, রাজশাহী শহরের দিকে নিয়ে আসা হয়।
ইব্রাহীম খলিলের সঙ্গে কথা হয় গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী নগরের মোহনপুর এলাকায়। তাঁর ছোট–বড় মিলিয়ে ২১টি গরু আছে। আটটি গাভির পাশাপাশি আটটি বাছুর গরু। গরুর পালের সঙ্গে ছোট-বড় মিলিয়ে ছয়টি ভেড়াও এনেছেন চরাতে।
কথায় কথায় তিনি বলতে থাকেন, তাঁর বাবা ও দাদারাও গরু পালতেন। পদ্মার চর তাঁদের জন্য একরকম নিয়ামত। গরুগুলো ছয় মাস চরে রাখেন, আর ছয় মাস পদ্মায় নেওয়া যায় না। এ সময়ে ঘাস থাকে না চরগুলোয়।
ইব্রাহীম বলেন, ভোরে গরুগুলো নিয়ে বের হয়েছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে গরুগুলো নিয়ে বাসায় যাবেন। একটু গরম পানি করে হালকা ভুসি খাওয়াবেন। তিনি বলেন, গরু পালার জন্য পদ্মার চরই তাঁদের ভরসা। তবে পাঁচ-ছয় মাস তাদের শহরেই রাখতে হয়। আগস্টে বন্যা হলে চরগুলো ডুবে যায়। পরে পানি শুকিয়ে গেলে ঘাস গজায়। শীতে শুকনা মৌসুমে ঘাসও মরে যায়। তখন ভরসা থাকে না চরে। এ কারণে গরুগুলো নদী থেকে শহরের আনাচকানাচে আনতে হয়।
ইব্রাহিম আরও বলেন, শহরে খোলা জায়গা কম। রাস্তার ধারে, গাছপালা ঘেরা বাগানে, খেলার মাঠে। কারও বাড়ির আঙিনায় নিয়ে গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াতে হয়। এতে অনেকেই গালমন্দ করেন। কেউ কেউ তেড়েও আসে। হাসিমুখেই সবকিছু মেনে নেন।
হেসে হেসে ইব্রাহিম বলতে থাকেন গরু পালা লাভজনক। তিনি বলেন, ‘গরু পাললে তো বেঁচে টাকা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া সকালে দুধ দেয়। এর গোবরও কাজে লাগে।’
গরুগুলো ইব্রাহীমের কথা বুঝতে পারে। হাতে লাঠি থাকলেও আঘাত করেন না তিনি। ‘হো, হেই, আয়, যা, ’ বললেই গরুগুলো বুঝতে পারে। আবার থামতে বললে থেমেও যায়। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এই শব্দগুলো করেই গরুগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তিনি বলেন, ‘আপনি যাকে আপন করে যত্ন করে পালবেন, সে আপনার কথা শুনবে। আমার গরুগুলো খুব শান্ত। আমার কথা ওরা বুঝে। এরাও আমার পরিবারের সদস্য।’