যেমন আছে সেচের পানির জন্য প্রাণ দেওয়া দুই ভাইয়ের পরিবার

সেচের পানির জন্য প্রাণ দেওয়া কৃষক অভিনাথ মারানডির স্ত্রী ও দুই সন্তান। গত শনিবার সন্ধ্যায় রাজশাহীর গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সেচের পানির জন্য ধরনা দিয়ে না পেয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষক অভিনাথ মারানডি ও তাঁর চাচাত ভাই রবি মারানডি। তাঁদের মৃত্যুর এক বছর পার হয়েছে। এবার আর অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রমের সেই ধানের জমি নেই। তিনি কোনো ধান চাষ করেননি। অন্যের জমিতে পুরুষের চেয়ে ৫০ টাকা কম মজুরিতে কাজ করে দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘটু গ্রামের সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারানডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মারানডি গত বছর ২৩ মার্চ সেচের পানি না পেয়ে বিষ পান করেন। এতে অভিনাথ সেদিনই মারা যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ মার্চ মারা যান রবি।

পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, দুই কৃষককে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন বোরো ধানের জমিতে সেচের পানি দিচ্ছিলেন না। পানি না দিলে তাঁরা বিষ খেতে চাইলে সাখাওয়াত তাঁদের বিষ খেতেই বলেছিলেন। এ নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়। ঘটনার ১১ দিন পর পুলিশ সাখাওয়াতকে গ্রেপ্তার করে। সেদিনই বিএমডিএ সাখাওয়াতকে চাকরিচ্যুত করে। পরে সাখাওয়াতের নামেই পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়। সেই মামলা এখন চলমান রয়েছে।

কেমন আছেন এই দুই পরিবারের সদস্যরা

গত শুক্রবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম কাজে গিয়ে প্রায় সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন। গত শনিবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যায় নিমঘটু গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অভিনাথের ভিটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর উঠেছে। কিন্তু সেই ঘরে অভিনাথের স্ত্রী–সন্তানেরা থাকেন না।

বাড়িতে পাওয়া যায় রোজিনা হেমব্রমকে। তিনি বললেন, ঘর বানানোর ছয় মাসের বেশি হয়েছে। কিন্তু ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। আবেদন করেছেন, কিন্তু এখনো সংযোগ পাননি। তাই তিনি রাতে শাশুড়ির বাড়িতে ঘুমান।

অভিনাথের মৃত্যুর পরে তাঁর বড় ছেলে হৃদয় মারানডিকে মিশন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। আর ছোট ছেলে কুমার মারানডি প্রথম শ্রেণিতে গ্রামের স্কুলে যায়।

এবার কোনো আবাদ করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে রোজিনা বলেন, তাঁর স্বামীর নিজের কোনো জমি ছিল না। শাশুড়ি তাঁর দেড় বিঘা জমি ধান চাষ করতে দিয়েছিলেন। অভিনাথ মারা যাওয়ার পরে তাঁর স্ত্রীকে আর সেই জমি দেননি। রোজিনা জানান, পানির জন্য একইভাবে ঘুরতে হবে। হয়তো রাতে সিরিয়াল পড়বে। মেয়ে মানুষের পক্ষে রাতে জমির পানি নিতে যাওয়া সম্ভব হবে না। এ জন্য শাশুড়ি জমিটা তাঁর দেবর হরেনকে দিয়েছেন। হরেন আবাদ করছেন।

কীভাবে সংসার চলছে জানতে চাইলে রোজিনা বলেন, তিনি মাঠে কাজ করেন। এখন আলু তোলার মৌসুম। সারাদিন কাজ করলে ২৫০ টাকা পান। পুরুষদের দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। এভাবে কাজ করেই তিনি দুই সন্তানকে মানুষ করছেন।

দেখা গেল বাড়ির আঙিনায় বাঁশঝাড়ের নিচে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের দেওয়া বাছুর গরুটি বাঁধা রয়েছে। রোজিনা বলেন, যত কষ্টই হোক গরুটি তিনি বিক্রি করবেন না। মামলার কোনো খোঁজ রাখেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলা চলছে। নিজের কোনো উকিল দেওয়া হয়েছে কি না, তিনি জানেন না। মামলাটি সিসিবিভিও নামে স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা দেখভাল করে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিসিবিভিওর কর্মসূচি সমন্বয়কারী আরিফ ইথার বলেন, মামলাটি সাক্ষী পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ২৬ এপ্রিল ধার্য দিন রয়েছে।

গত শনিবার সন্ধ্যায় রবি মারানডির বাড়িতে তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিলেন না। রবি অবিবাহিত ছিলেন। তার প্রতিবেশী কংগ্রেস টুডু জানান, রবির ভাই সুশীল মারানডি গতবারের জমিতে এবার ধান চাষ করেছেন। এখনো পর্যন্ত পানির সংকট দেখা দেয়নি। সবে ধান লাগানো হয়েছে। পরে কী হবে বলতে পারছেন না।