দেশে সুশাসন না থাকলে পরিবেশ-প্রকৃতিও হুমকিতে পড়ে। প্রাকৃতিক সম্পদ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এ জন্য পরিবেশ-প্রতিবেশ-জীবকুলের স্বার্থেই পরিবেশগত সুশাসন ও ন্যায্যতা থাকা অপরিহার্য। আজ বৃহস্পতিবার বরিশালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় মতবিনিময় সভায় বক্তারা পরিবেশ রক্ষায় নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে এ কথা বলেন।
বরিশাল নগরের সদর রোডের বিডিএস মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার বেলার নেটওয়ার্ক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ভোলার বিশিষ্ট নাগরিক নেতা ও পরিবেশ সংগঠক মোবাশ্বের উল্লাহ।
সভায় বরিশাল ছাড়াও বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, ভোলা জেলার পরিবেশ সংগঠকেরা অংশ নেন। সভার শুরুতে বেলার কার্যক্রম নিয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির মাঠ সমন্বয়ক এ এম এ মামুন।
সভায় প্রতিষ্ঠার পর ৩২ বছরে বেলা পরিবেশ সুরক্ষা, সুশাসন এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন কার্যক্রম ও আইনি লড়াই নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবী আসাদুল্লাহ আল গালিব।
মতবিনিময় সভায় বরিশাল নগরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বক্তারা বলেন, এই নগরের ২৪টি খাল এবং অসংখ্যা দিঘি ও পুকুর ছিল। কিন্তু এসব ভরাট ও দখল করে পুরো নগরের পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করা হয়েছে। জীববৈচিত্র্য হুমকিতে ফেলা হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে এখন নগরজীবনে। সামান্য বৃষ্টি হলে নগরের ৮০ শতাংশ এলাকায় মারাত্মক জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণে এখন যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তা-ও ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে।
বক্তারা বলেন, এখন আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো বহুতল ভবনের নামে অপরিকল্পিত আবাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এ জন্য তারা নদী থেকে বালু এনে ডোবা-নালা ভরাট করা হচ্ছে। পরিবেশ-প্রকৃতির দিক বিবেচনা না করে শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে বহুতল ভবন নির্মাণ করে পুরো নগরের পরিবেশ-প্রতিবেশব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশন পুরোপুরি নির্বিকার। বরিশাল নগরকে মানুষের বাসযোগ্য করতে হলে এর বিরুদ্ধে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথে নামতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক রফিকুল আলম বলেন, দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন না থাকলে পরিবেশগত সুশাসন ও ন্যায্যতাও থাকে না। দেশে পরিবেশ-প্রকৃতিঘাতী যেসব কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তা কেবল সুশানের অভাবেই হয়েছে। এ জন্য দেশে গণতন্ত্র থাকলে শুধু মানুষ নয়, দেশের সবকিছুই নিরাপদ থাকে, সুরক্ষিত থাকে। বরিশাল নগরে গত ২০ বছরে যে প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুরতা হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে। শুধু বরিশাল নয়, পুরো দেশে এই একই চিত্র। এ জন্য পরিবেশবাদীদের নিজেদের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে পরিবেশগত সুশাসন ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য আইনগত ভিত্তি তৈরির জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জোরালোভাবে দাবি তুলে ধরতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মোবাশ্বের উল্লাহ বলেন, গোটা দক্ষিণাঞ্চলে মেগা প্রকল্পের নামে বন, নদী, জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস ও হুমকিতে ফেলা হয়েছে। এখন আমাদের যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তাকে সুরক্ষা করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে জোরালো আওয়াজ তুলতে হবে। সরকারের ওপর নাগরিকদের চাপ সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা, ন্যায্যতা, এটা নাগরিকদের আইনি অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
সভায় বেলার আইনজীবী আসাদুল্লাহ আল গালিব বলেন, বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন খাল, নদী, জলাশয় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক স্থাপনা সুরক্ষায় বেলা উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে এ পর্যন্ত ১৫টি মামলা করেছে। এসব মামলার তিনটিতে আদালতের মাধ্যমে আইনি সুরক্ষা পেয়েছে। বাকি মামলাগুলো চলমান। তবে এতে প্রাকৃতিক স্থাপনাগুলো ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া চলছিল, তা বন্ধ আছে।
মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন বেলার বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক লিংকন বায়েন। এতে বরিশালের পরিবেশ সংগঠক রনজিৎ কুমার দত্ত, শুভংকর চক্রবর্তী, সাংবাদিক নেতা স্বপন খন্দকার, প্রথম আলোর বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর কহিনূর বেগম, আইনজীবী শহিদুল্লাহ খান, পটুয়াখালীর পরিবেশ সংগঠক পারভীন সুলতানা, আইনজীবী ফাতেমা বেগম প্রমুখ বক্তব্য দেন।