মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কয়েক দফা প্লাবিত হয় রোপা আমনের ধানখেত। কৃষকেরা থেমে না গিয়ে ধানখেতে পরিচর্যা অব্যাহত রাখেন। তাঁদের সেই চেষ্টা বৃথা যায়নি। ফসলে ভরে গেছে খেত। আর তাতে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁরা।
বুধবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত জুড়ী উপজেলা সদর, জায়ফরনগর, সাগরনাল, ফুলতলা ও গোয়ালবাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোনো জমির ধান কাটা শেষ। কোনো জমির ধান কাটা চলছে। কোনো জমির ধান এখনো কাটা শুরু হয়নি। কোথাও ধান কাটার পর মাড়াই শেষে জমিতে ধান শুকানো হচ্ছে। আবার কোনো জমির পাশে পাকা সড়কে শুকানো হচ্ছে ধান। জমি ও সড়কে খড় শুকানো হচ্ছে। ধান কাটার পর জমিগুলো গবাদিপশুর চারণভূমি হয়ে উঠেছে। নানা প্রজাতির পাখি জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধান খুঁজে খাচ্ছে।
জুড়ী-বটুলি শুল্ক স্টেশন সড়কের দুই পাশে জায়ফরনগর, সাগরনাল, ফুলতলা ও গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের রোপা আমনের বিস্তীর্ণ জমি। সেখানে ছোট ছোট কয়েকটি হাওরও আছে। এসব হাওরে ধানে সোনালি রং ধরেছে। ফলনের ভারে ধানগাছ নুয়ে পড়েছে। অনেকে ধান কেটে ফসল ঘরে তুলেছেন।
ফুলতলার পশ্চিম বিরইনতলা এলাকার বর্গাচাষি আলী আব্বাস চার বিঘা জমিতে রোপা আমনের আবাদ করেন। দুপুরের প্রখর রোদে তিনি ধান শুকাচ্ছিলেন। কাজের ফাঁকে আলী আব্বাস বলেন, ‘তিনবার গোলা (পাহাড়ি ঢল) নামিয়া জমিন ডুবল। তবে পানি নামি গেছে তাড়াতাড়ি। ক্ষতি কিছু হইছে। এরপরও ফসল খারাপ হইছে না। চার হাঁটু (প্রায় ৫০ মণ) মিলছে। কিছু ধান চোচা (চিটা) হই গেছে। এখন শুকাইয়া ঘরো তুলমু।’
পাশে সড়কে কুলা দিয়ে ধান ঝাড়ছিলেন একই এলাকার মিনারা খাতুন। তিনি বললেন, তাঁর স্বামী দুদুল মিয়া বর্গাচাষি। দুই বিঘা জমিতে স্বর্ণমশুরি জাতের রোপা আমনের আবাদ করে প্রায় ২৪ মণ ধান পেয়েছেন।
ফুলতলা চা-বাগান এলাকায় নিজের জমির ধান কাটছিলেন বাগানের শ্রমিক বিজয় ভূমিজ। তাঁকে আরও দুই শ্রমিক কাজে সহযোগিতা করছিলেন। বিদ্যালয়ে ছুটির পর বাড়ি ফিরে বিজয়ের দুই শিশুসন্তান তাঁদের জন্য দুপুরের খাবার ও পানি নিয়ে এসেছিল। বিজয় বলেন, ‘ধান যে টিকব, এই আশাই ছাড়ি দিছিলাম।। গোলার পানি নামার পরে দেখি টিকি গেছে। ফসল ভালাই হইছে। ঈশ্বর যা দিছেন তাতেই খুশি।’
সাগরনালের উত্তর সাগরনাল এলাকায় প্রায় সব জমির ধান কাটা শেষ। সেখানে জমিতে ধান শুকাচ্ছিলেন বর্গাচাষি নজীব আলীর স্ত্রী আয়েশা বেগম। জমিতে খড় দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘরের ভেতরে কয়েকটি ধানভর্তি বস্তা রাখা। আয়েশা বললেন, আট বিঘায় তাঁরা আবাদ করেন। পাহাড়ি ঢলে পুরো হাওরের ধান দুই দফা ডুবে গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ধানের ভালো ফলন পেয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্ট মাসে রোপা আমন ধানের আবাদ শুরু হয়। আগস্ট মাসে অতিবৃষ্টি ও উজানের ভারত থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে বিভিন্ন স্থানে জুড়ী নদীর বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে তিন দফায় বন্যা দেখা দেয়। এতে উপজেলার ২ হাজার ২৮০ হেক্টর জমির রোপা আমন ধান তলিয়ে যায়। এর মধ্যে পুরোপুরি নষ্ট হয় ৯২০ হেক্টর জমির ধান। অনেক স্থানে বীজতলাও ডুবে যায়। পরে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কৃষক বিভিন্ন স্থান থেকে চারা সংগ্রহ করে জমিতে পুনরায় আবাদ শুরু করেন। চারাসংকটে কেউ কেউ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ধানের গোছা থেকে দু-তিনটি করে গোছা সংগ্রহ করে আবার সেগুলো জমিতে লাগান। এমন পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বর মাসে উপজেলা পরিষদের তহবিল থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬৪০ জন কৃষককে ৫ কেজি করে বিনা-১৭ ও ব্রি-৭৫ জাতের রোপা আমন ধানের বীজ দেওয়া হয়। এই দুই জাতের ধানে স্বল্প সময়ে ফলন আসে।
জুড়ী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম খান বলেন, এবার উপজেলায় মোট ৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৫৪ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। কয়েক দফা বন্যায় আবাদ পিছিয়ে পড়েছিল। এ কারণে দেরিতে ফলন এসেছে। মাঠ ঘুরে ফলন বেশ ভালো দেখা গেছে। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সব জমির ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন।