বর্ষা এলেও এমন পানিশূন্য হাওর আগে দেখেননি নেত্রকোনার মানুষ

আষাঢ় মাস চললেও নেত্রকোনায় হাওরে পানি নেই। গতকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি হওয়ায় কিছু স্থানে সামান্য পানি জমেছে। আজ শুক্রবার সকালে মদন উপজেলার উচিতপুর হাওরে
ছবি: প্রথম আলো

বছরের প্রায় সাত মাস পানি, আর পাঁচ মাস দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ। পানিতে থাকা মাছ আর মাঠে থাকা ধান—এই দুই সম্পদকে কেন্দ্র করে চলে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা। কখনো পানির ঢেউ বয়ে চলে, কখনো বোরো ধান বাতাসে দোল খায় হাওরের কোলে।

তবে এবার চিত্র ভিন্ন। প্রকৃতিতে বর্ষা শুরু হলেও নেত্রকোনার হাওরগুলোতে পানির দেখা নেই। পানিশূন্য বিস্তীর্ণ একেকটা হাওর যেন খাঁ খাঁ করছে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আশায় বুক বাঁধছেন হাওরের মানুষ। তাঁরা বলছেন, এই বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে হাওর পেতে পারে বর্ষার চেনা রূপ।

নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার পুরানহাটি এলাকার বাসিন্দা রহমত আলী তালুকদার (৮১) বলছিলেন, অন্যান্য বছর বৈশাখ মাস থেকে খাল-বিল ভরে হাওরজুড়ে পানি থাকে। কিন্তু আষাঢ় মাস এলেও এবার বৃষ্টির দেখা নেই, হাওরে পানি নেই। এর আগে কোনো বছর এমন পানিশূন্য হাওর তিনি দেখেননি। মৎস্যজীবী, নৌযানচালকসহ পানির ওপর নির্ভরশীল কেউ কেউ দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন।

হাওরাঞ্চলে মাছের ওপর অনেক মানুষ নির্ভর করেন। এবার পানি না থাকায় প্রজনন হচ্ছে না। মা মাছ ধরা পড়ছে। মিঠাপানির এসব মাছ, শামুকসহ জলজ প্রাণী অস্তিত্বসংকটে পড়বে।
মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, অধ্যাপক. অ্যাকুয়াকালচার বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১০টি উপজেলায় মোট ৬৮টি হাওর আছে। নদ-নদী ও খাল-বিলের সংখ্যা ১৮৮। সব মিলে জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরের আয়তন ৫৬ হাজার ৬৭৬ হেক্টর। বছরে এসব জলাশয় থেকে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। ৪৮ হাজার ৩৮৪ জন নিবন্ধিত মৎস্যজীবী মাছ আহরণ করে জীবিকা চালান।

জেলার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও কলমাকান্দার আংশিক এলাকা মূলত হাওরাঞ্চল। এ অঞ্চলে নিবন্ধিত মৎস্যজীবী ৩০ হাজার ১২৫ জন। অনিবন্ধিত মৌসুমি জেলে রয়েছেন আরও প্রায় ১২ হাজার। তাঁরা মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরে সংসার চালান। কিন্তু এবার এখনো নদী-নালা, খাল-বিল ও হাওরে পানি না আসায় তাঁরা মাছ ধরতে পারছেন না। মাছের প্রজননকাল ও ডিম ছাড়ার সময় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। পানি না থাকায় মা মাছ ডিম ফুটিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারছে না। মাছের পাশাপাশি ঝিনুক, শামুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ কমে যাচ্ছে। মৎস্যজীবীদের মতো অলস-বেকার সময় কাটাতে হচ্ছে নৌযানচালকসহ নৌঘাটের স্বল্প আয়ের মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।

বর্ষা চললেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় হাওরে পানি নেই।গত মঙ্গলবার বিকেলে খালিয়াজুরির লক্ষ্মীপুর হাওরে

হাওর দ্বীপখ্যাত খালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, হাওর, খাল, বিল—কোথাও পানি নেই। যেটুকু পানি আছে, তা তলানিতে। বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো শুকনা। ধুন নদের পানিও কম। জেলেরা শিকারে বের হয়ে মাছ না পেয়ে নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরছেন। কেউ কেউ গ্রাম্য বাজারের পাশে বেঞ্চে বসে লুডু ও তাস খেলছেন।

উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের মৎস্যজীবী ক্ষিতিরীন্দ্র চন্দ্র বর্মণ (৫২) বলেন, ‘আমার জমিজমা নাই। মাছ ধইরা সংসার চালাই। এইবার হাওরে পানি না থাহনে আমার মতো জেলেদের দুই বেলা ভাত খাওয়া পর্যন্ত কঠিন হইয়া যাইতাছে। অহন বর্ষা মৌসুম, হাওরে মাছ থাহনের কথা। কিন্তু পানিও নাই, মাছও নাই। পোলাপান লইয়া সংসার চালাইতে কষ্ট হইতাছে।’

জেলার সবচেয়ে বড় হাওর মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপোতা। প্রায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে থাকা ওই হাওর পানিশূন্য। ডিঙ্গাপোতা হাওরপারের খুরশিমুল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘৭৫ বছর বয়সে এমন পানিশূন্য হাওর আর কখনো আমি দেখিনি। এলাকায় মাছের আকাল দেখা দিচ্ছে। জেলেরা কষ্টে আছে। নৌচালকেরাও বেকার সময় কাটাচ্ছে।’

মদনের উচিতপুর নৌঘাটটি এ বছর সাড়ে ২৬ লাখ টাকায় ইজারা পান ওই এলাকার হালিম মিয়া। আর উচিতপুর পর্যটনকেন্দ্রটি ইজারা দেওয়া হয় ১ লাখ ৩০০ টাকায়। ইজারাদাররা জানান, অন্যান্য বছর এপ্রিল মাস থেকে উচিতপুর ঘাটে প্রতিদিন সহস্রাধিক নৌকা–ট্রলার আসা-যাওয়া করত। এবার পানি না থাকায় সব বন্ধ। প্রচুর লোকসানে পড়তে হচ্ছে।

হাওরে পানি না থাকায় বিপাকে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা। আজ শুক্রবার সকালে মদন উপজেলার উচিতপুর হাওরে

হাওর এলাকায় বর্ষায় চলাচলের প্রধান মাধ্যম নৌকা। পানি না থাকায় এবার নৌকা বানানোর কারিগরেরাও বেকার। কলমাকান্দার নওয়াপাড়া গ্রামের সুনীল বিশ্বশর্মা জানান, প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দিক থেকে তাঁদের গ্রামের ২৫ জনের মতো কাঠমিস্ত্রি ছোট ছোট ডিঙি নৌকা বানানোর কাজ করেন। একেকটি নৌকার মজুরি দেড় থেকে তিন হাজার টাকা। কিন্তু এবার পানি না থাকায় এ কাজ বন্ধ। এতে রোজগার কমে যাচ্ছে।

হাওরকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে হাঁসের খামার। হাওরে পানি না থাকায় খামারিও বিপাকে আছেন। মদনের বাগজান এলাকার খামারি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘হাওরে এই সময় থই থই পানি থাহনের কথা। হাঁস ছেড়ে দিলে হাওর, বিল ও খালে ঘুরে শামুক, পোকা, কেঁচো খেয়ে আসত। এতে প্রায় ৭০ ভাগ খাবার কম লাগত। এটা এবার লাগছে।’

নেত্রকোনা পাউবো কার্যালয়ের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী বর্তমানে ঢাকা কার্যালয়ে কর্মরত মোহন লাল সৈকত জানান, গত বছরের ৩০ মার্চ থেকে টানা কয়েক দিন ভারতের চেরাপুঞ্জি ও নেত্রকোনায় প্রচুর বৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পড়ে হাওরাঞ্চলে। গত বছরের ৩০ মার্চ থেকে ১ জুন পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে ৪ হাজার ৪২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আর নেত্রকোনার দুর্গাপুরে ১ হাজার ৫৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার। অথচ এবার ওই সময়ের মধ্যে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্ট হয় ৬৭৫ দশমিক ৭ মিলিমিটার। নেত্রকোনার দুর্গাপুরে হয় ৩৪৪ দশমিক ২৬ মিলিমিটার বৃষ্টি।

খালিয়াজুরীর খলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় হাওরগবেষক সঞ্জয় সরকার বলেন, ধান ও মাছ—এই দুই সম্পদের ওপর ভিত্তি করে হাওরের মানুষের সারা বছরের সংসার খরচ, সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা, আচার-অনুষ্ঠান—সবকিছু নির্ভর করে। এ বছর হাওরে পানি আসতে দেরি হওয়ায় মৎস্যজীবীরা যেমন বিপাকে, তেমনি হাওরের মৌসুমি মাঝি-মাল্লারাও। পানি এলে পর্যটকদের ঢল নামে। এতে নৌকার মাঝিদের যে আয় হয়, তা দিয়ে তাঁদের সংসার চলে। পানি না আসার কারণে এ অঞ্চলের হাটবাজারগুলোতেও মাছের সংকটও দেখা দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, হাওরাঞ্চলে মাছের ওপর অনেক মানুষ নির্ভর করেন। এবার পানি না থাকায় প্রজনন হচ্ছে না। মা মাছ ধরা পড়ছে। মিঠাপানির এসব মাছ, শামুকসহ জলজ প্রাণী অস্তিত্বসংকটে পড়বে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেবে।

তবে আশার কথাও শোনালেন অধ্যাপক মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, আশার কথা হচ্ছে, হাওরে নানা রকমের মাছ থাকে। পানি এলে এসব মাছের দুই থেকে তিনবার ডিম পাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পানিতে থাকা প্লাঙ্কটন ছাড়াও জলজ গাছ ও আগাছার গায়ে মাছের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাবার পেরিফাইটনের উৎপাদন মাছের শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়ক। যে জলাশয় আছে, তা যেন শুকিয়ে না ফেলা হয়, মা ও পোনা মাছ যেন না ধরা হয়, সে ব্যাপারে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ, প্রশাসনসহ জনসাধারণের নজর রাখার আহ্বান জানান তিনি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবীর বলেন, জেলায় বছরে উৎপাদিত প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন মাছের মধ্যে অর্ধেকের বেশি হয় হাওরে। এবার হাওরে পানি না আসায় মাছের উৎপাদন কিছুটা কমবে। তবে পানি এলেই প্রচুর পোনা অবমুক্ত করা হবে। প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে মাছ দ্রুত বড় হবে। এ ছাড়া মৎস্য আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।