নিজের ভাতের হোটেলে খাবার পরিবেশন করছেন বৃদ্ধ আজাহার ইসলাম। সম্প্রতি দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায়
নিজের ভাতের হোটেলে খাবার পরিবেশন করছেন বৃদ্ধ আজাহার ইসলাম। সম্প্রতি দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায়

ভাতের হোটেল চালানো আজাহার যেভাবে সবার ‘বন্ধু’ হলেন

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় ভাতের হোটেল চালান আজাহার ইসলাম। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি হোটেলটি পরিচালনা করেন। তাঁর হোটেলের ক্রেতা বিশ্ববিদালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। তুলনামূলক কম দামে সকাল, দুপুর ও রাতে হোটেলটির খাবার খেয়ে বেশ তৃপ্ত স্থানীয় লোকজন। সেই সঙ্গে তাঁর আন্তরিক ও সৌহার্দপূর্ণ আচরণের কারণে সবার কাছে তিনি ‘বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত।

আজাহার ইসলামের ভাতের হোটেলে কেউ কেউ বাকি খান। কেউ কম দাম দিয়ে বেশি খাবার খান। আবার কেউ খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয়ে ভালোবেসে বেশি টাকাও দিয়ে যান। কারও কাছে টাকা না থাকলেও বিনা মূল্যেও খাওয়ান তিনি। সম্প্রতি তাঁর ব্যবসার পুঁজি তলানিতে নেমে এসেছে। তবুও চোখেমুখে হাসি ধরে রাখেন ৬৯ বছর বয়সী আজাহার।

আলাপকালে আজাহার ইসলাম জানান, তাঁর রান্না ভালো। শিক্ষার্থীরা ভালোবেসে তাঁর হোটেলে খেতে আসেন। টাকা না থাকলেও তাঁরা খেতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে তারা বন্ধু মনে করে। লাভের কথা চিন্তা করি কী হবে?’ এই হোটেলে এক প্লেট ভাতের দাম ১০ টাকা, ৩ পদের শাক-তরকারি ১৫ টাকা। সব মিলে ৩৫ টাকায় রাতের খাবার শেষ করা যায়। তবে মাছ–মাংস খেলে টাকা বেশি লাগে।

নিজের হোটেলে বসে আছেন আজাহার ইসলাম। সম্প্রতি দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায়

আজাহার ইসলাম বলেন, ১৯৭৯ সালের কথা। হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় তখন কৃষি কলেজ ছিল। সেখানে ১৯৮৬ সালে চায়ের দোকান শুরু করেন তিনি। তাঁর বাড়ি দিনাজপুর শহরের জামাইপাড়া এলাকায়। তবে সেই বাড়ি এখন বড় ভাইয়ের দখলে। স্ত্রী, তিন সন্তান ও পূত্রবধূদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি।

আজাহার ইসলাম জানান, কয়েক বছর আগেও তিন বেলা দোকানে কয়েক পদের মাছ, মাংস, ডিম, কলিজা, মুরগি, নানা পদের শাক-ভর্তা বিক্রি করতেন। এখন শুধু দুপুর আর রাতে বিক্রি করেন। খাবারের পদও কমে গেছে। দৈনিক ২০-২৫ হাজার টাকা বিক্রি হতো, এখন ৫-৬ হাজার টাকাই বিক্রি হয় না। তাঁর ভাষায়, ‘দোকানের হিসাব খুঁজি পাইলাম না। ৪০ বছর হয়ে গেল, কোনো আয়–উন্নতি করার পারি নাই। ঘুমানোর জায়গাটাও নাই।’

পাশেই বসা এক শিক্ষার্থী তখন বলেন, লাভ খুঁজি পাবেন না তো বন্ধু। কেউ আছে মাসের প্রথমে এক হাজার টাকা জমা দেন। তারপর সারা মাস খাওয়া চলে। কেউ একই দাম দিয়ে তিনবার তরকারি নেন। খাতায় শিক্ষার্থীরাই যে যাঁর মতো হিসাব রাখেন। প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ জন ভিক্ষুককেও বন্ধু বিনা টাকায় খাওয়ান। আশপাশের হোটেলগুলোর চাইতে এখানে প্রতি পদ অন্তত ৫-১০ টাকা কম। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ খেয়ে আবার ৫-২০ টাকা কম দেন। শুধু একটু কায়দা করে কষ্টের কথা বলতে পারলে টাকাই নেন না বন্ধু।

প্রত্যেককে দৈনিক ১০০ টাকা মজুরি দেন। কোনো দিন সেটাও দিতে পারেন না।
আজাহার ইসলাম, ভাতের হোটেল মালিক
নিজের হোটেলে কাজ করেছেন আজাহার ইসলাম

আজাহার ইসলাম তিন ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। এক ছেলে পোশাক কারখানার কর্মী, একজন দিনমজুর। স্ত্রী, আরেক ছেলে ও পুত্রবধূরা হোটেলেই কাজ করেন। আজাহার বলেন, প্রত্যেককে দৈনিক ১০০ টাকা মজুরি দেন। কোনো দিন সেটাও দিতে পারেন না।

চাচিকে মজুরি দেন কি না, জানতে চাইলে আজাহার বললেন, ‘ওকে দেওয়া লাগে না।’ টেবিল পরিষ্কার করছিলেন আজাহারের স্ত্রী জয়নব। তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে ‘বান্ধবী’ হিসেবে পরিচিত। জয়নব বলেন, ‘খালি হাত–পাও দিয়া আয়-ইনকাম করিয়া কোনোমতে খায়দায়ে চলেছি।’

আজাহার ইসলাম জানান, ১৪ বছর আগে একবার হোটেলে চুরি হয়। সেই থেকে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী রাতে হোটেলেই ঘুমান। বর্তমানে তাঁর ব্যবসায় দেড় লাখ টাকার ঘাটতি। এই ঘাটতি কোনোভাবেই পুষিয়ে উঠতে পারছেন না।

খাওয়া শেষে টাকা পরিশোধ করছেন এক ক্রেতা। সম্প্রতি দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায়
১৯৭৯ সালের কথা। হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় তখন কৃষি কলেজ ছিল। সেখানে ১৯৮৬ সালে চায়ের দোকান শুরু করেন আজাহার ইসলাম। তাঁর বাড়ি দিনাজপুর শহরের জামাইপাড়া এলাকায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোরশেদুল আলম বলেন, ‘বন্ধু লোকটা সাদাসিধে। এই কারণে কিছু কিছু শিক্ষার্থী ঠিকমতো টাকা দেন না।’ তিনি বলেন, এখন তো শুক্রবার হোটেল বন্ধ রাখেন। কারণ হিসেবে বন্ধু তাঁদের বলেছেন, শুক্রবারে ভিড় বেশি হয়, কে কোন দিকে খেয়ে যান, হিসাব রাখতে পারেন না। ওই দিন বিক্রি বেশি হয়, লোকসানও নাকি বেশি হয়। তবে সব শিক্ষার্থী এমন করেন না। বন্ধুর বিপদের দিনে অনেক শিক্ষার্থীই পাশে দাঁড়ান। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এদিকে এলে বন্ধুর হোটেলে যান, খোঁজখবর নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন রুবায়েত নোমান। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘বন্ধু খুব ভালো রান্না করেন। তবে মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যান। আবার দেখি হঠাৎ হোটেল চালু করেন। কিছুদিন আগেই তাঁর হোটেলে খেয়ে এসেছি। পারিবারিক কিছু ঝামেলা ছিল বন্ধুর। ঠিকমতো ব্যবসাটা করতে পারলে এত দিনে অন্তত তিনটি হোটেলের মালিক হতেন। তবে এটা সত্য, তিনি শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের বন্ধু।’