বিয়ের অনুষ্ঠানের আনন্দের বদলে রইছ উদ্দিনের বাড়িতে চলছে মাতম

সুজন মিয়া ও ফাতেমা বেগম
ছবি : পরিবারের সৌজন্যে

পাশাপাশি চারটি কবর খোঁড়া হচ্ছে বাড়ির পাশে। কয়েকজন দাঁড়িয়ে তা দেখছিলেন। আবার কেউ জানাজার জন্য আঙিনা পরিচ্ছন্ন করছিলেন। কেউ লাশ গোসলের কাজ করছিলেন। এর মধ্যে কানে আসে রইছ উদ্দিনের বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ।

আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বনাটি গাঙ্গাইল পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় এ দৃশ্য। অথচ তিন দিন আগে পরিবারের এক সদস্যের বিয়ে উপলক্ষে এই বাড়িতে আনন্দ-উৎসবের কমতি ছিল না। ভৈরবের ট্রেন দুর্ঘটনায় পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় নিমেষেই সব ওলটপালট হয়ে গেছে।

গতকাল সোমবার কিশোরগঞ্জের ভৈরব জংশনের আউটার সিগন্যালে এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় রইছ উদ্দিনের ছেলে সুজন মিয়া (৩৫), তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম এবং দুই ছেলে সজিব (১৪) ও ইসমাইল হোসেন (১০) মারা গেছেন। ট্রেনে সুজনের সঙ্গে তাঁর বড় ভাই স্বপন মিয়া ও ভাবি রেশমা বেগমও ছিলেন। তবে তাঁরা বেঁচে গেছেন।

আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দাফনের কাজ শেষ হয়। জানাজার পর উঠানে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন রইছ উদ্দিন (৭৫)। কয়েকজন স্বজন তাঁকে ধরে রেখেছিলেন, যাতে তিনি পড়ে না যান। রইছ উদ্দিন বলেন, তাঁর চার ছেলে ও তাঁদের পরিবারের ২৪ সদস্য ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডাব বিক্রি করেন। বাড়িতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী থাকেন। ঈদ বা কোনো অনুষ্ঠান হলে তাঁর চার ছেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ি চলে আসতেন।

রইছ উদ্দিন আরও বলেন, গত শুক্রবার ছিল তাঁর বড় ছেলে রমজান মিয়ার প্রথম সন্তান মো. রোমান মিয়ার (২০) বিয়ে। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সবাই বাড়ি চলে আসেন। বিয়ের বাকি কাজ শেষ করার জন্য তাঁর দুই ছেলে রমজান মিয়া ও মিজান মিয়া বাড়িতে থেকে যান। অন্যদিকে সুজন মিয়া ও স্বপন মিয়া দুই দিন কিশোরগঞ্জে বোনের বাসায় বেড়ান। সেখান থেকে দুই ভাই গতকাল এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেনে করে ঢাকায় রওনা দেন।

সজীব মিয়া (১৪)

স্বপন মিয়া (৪০) বলেন, ট্রেনে তাঁরা দুজন দুই বগিতে চড়েন। কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনে তাঁদের বহন করা বগি দুটি ছিল ইঞ্জিন–সংলগ্ন। কিন্তু ট্রেনটি ভৈরব জংশনে যাওয়ার পর ইঞ্জিন ঘোরানোয় বগি দুটি ট্রেনের শেষ দিকে চলে যায়। শেষ বগিতে ছিলেন তাঁর ভাই সুজন ও তাঁর (সুজন) পরিবারের সদস্যরা। দুর্ঘটনার পর সুজন মিয়া যে বগিতে চড়েছিলেন, সেটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুজনসহ তাঁর পরিবারের চার সদস্য সেখানেই মারা যান।

স্বপন মিয়া বলেন, ‘বাড়িতে আসার সময় আমরা চার ভাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে ট্রেনে করে বাড়িতে আসি। কিন্তু সেই ট্রেন আমাদের এক ভাইকে আমাদের কাছ থেকে চিরতরে কেড়ে নিয়েছে।’

সুজন মিয়ার মা মহিলা আক্তারকে গ্রামের নারীরা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাবারে দুইডা নাতিরে খুব আদার কইরা বিদায় দিছি। এই বিদায় যে শেষবিদায় অইবো সেইডা কি জানতাম।’

জয়নাল মিয়া নামের গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘সুজন মিয়া ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁদের বাবার তেমন জমি নেই। তাঁরা ভাইয়েরা যার-যার মতো করে সংসার চালাতেন।’

এক পরিবারের চার সদস্যের মৃত্যুর খবর পেয়ে বনাটি গ্রামে যান নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরুণ কৃষ্ণ পাল ও নান্দাইল মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ রাশেদুজ্জমান। তাঁরা নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।