রিকশাচালক সফর আলী (৫২) যেখানেই থাকেন, ইফতারের আগে আগে চলে আসেন সুনামগঞ্জ শহরের কবি মমিনুল মউজদীন সড়কে। সেখানে তাঁর জন্য ইফতারির প্যাকেট তৈরি থাকে। গত তিন বছর রোজার বেশির ভাগ দিন এখানেই ইফতার করেছেন তিনি। এর জন্য কোনো টাকা দিতে হয়নি।
সফর আলী একা নন, তাঁর মতো শ্রমজীবী মানুষদের জন্য প্রতিদিন এখানে ইফতারের আয়োজন থাকে। পুরুষের পাশাপাশি নারী, শিশুরাও ইফতারের জন্য জড়ো হন এখানে। এরপর সারি ধরে ইফতারি নিয়ে ফেরেন তাঁরা। প্রতিদিন ২০০ মানুষের ইফতারের আয়োজন হয় এখানে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কয়েকজন তরুণ গত পাঁচ বছর প্রতি রমজানে পুরো মাস দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষদের জন্য এই ইফতারের আয়োজন করে আসছেন। এর জন্য নিজেরা যেমন অর্থ দেন, তেমনি তাঁদের এই উদ্যোগে অর্থ দিয়ে পাশে থাকেন দেশে-বিদেশের অনেকে। প্রতিদিন ২০০ জনের ইফতারে ব্যয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। শুধু ইফতার নয়, বন্যা, করোনাসহ নানা সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এসব তরুণ। গত বছরের আগস্টে বান্দরবানে বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য সুনামগঞ্জ থেকে সহায়তা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। একটি সংগঠনও আছে তাঁদের, নাম ‘সোশ্যাল চ্যারিটি ফাউন্ডেশন’। সংগঠনের পুরো কাজের সমন্বয় করেন নাসিম চৌধুরী। বলা যায় তিনিই দলনেতা।
২০১১ সালের কথা। প্রথমে বন্ধুরা মিলে এক ঈদে চিন্তা করেন একবেলা সুবিধাবঞ্চিত ও হতদরিদ্র কিছু মানুষকে খাবার দেবেন। তখন সবাই শিক্ষার্থী। নিজেদের সঞ্চয় ও পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওই বছর কিছু মানুষকে একবেলা খাবার দেওয়ার কাজটি করেন তাঁরা। এতে অভিভাবকেরা উৎসাহ দেন। এরপর প্রতিবছর একই কাজ করতে থাকেন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের কারণে যখন লকডাউন শুরু হয়, তখন মানুষের পাশে থাকতে কী করা যায় ভাবতে শুরু করেন নাসিমরা। শুরু করেন খাবার বিতরণ। নিজেরা রান্না করে একটা নির্ধারিত সময়ে খাবার বিতরণ করতে থাকেন। এই উদ্যোগে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন। একই বছর থেকেই ইফতারি বিতরণের কাজটিও শুরু করেন তাঁরা। এর পর থেকে প্রতিবছর ইফতারি বিতরণ করছেন। শুরুতে নিজেরা রান্না করতেন। এখন পরিসর বড় হওয়ায় একজন বাবুর্চি আছেন। তবে রান্নার পর বাকি কাজ তাঁরা নিজেরাই করেন।
বিকেল থেকে ভিড়
ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই কবি মমিনুল মউজদীন সড়কে মানুষ জড়ে হতে থাকেন। এর মধ্যে শ্রমজীবীরা বেশি আসেন। আসেন আশপাশের এলাকার দরিদ্র পরিবারের নারীরা। শিশুরাও জড়ো হয় ইফতারি নিতে। সংগঠনের সদস্যরা সবাইকে সারি করে দাঁড় করান। একপাশে রাখা হয় শিশুদের। পরে সবার হাতে ইফতারির প্যাকেট তুলে দেওয়া হয়।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইফতারির জন্য সারি ধরে অপেক্ষায় আছেন লোকজন। সংগঠনের সদস্যরা ইফতারির প্যাকেট নিয়ে এসে তাঁদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। শহরের হাছননগর এলাকার শ্রমিক দিলরব আলী (৪৫) বলেন, ‘আমি সময় পাইলেই ইকান থাকি ইফতারি নিই। এখন আমার লগের আরও অনেকে আয়। ভালা ইফতারি দেয় তারা।’ সুলতানপুরের বাসিন্দা খুদেজা বেগম (৫০) বলেন, তাঁর ছেলে রিকশা মেরামতের কাজ করত। দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যাওয়ার পর এখন বাড়িতে থাকেন। সে জন্য এখান থেকে ইফতারি নিতে এসেছেন তিনি।
বড়দের সঙ্গে আসা দুই শিশু জানায়, তাদের বাবা ভাঙারির ব্যবসা করেন। দুই ভাই-বোন এখান থেকে প্রতিদিন ইফতারি নিয়ে যায়। এখানে যে ইফতারির প্যাকেট দেওয়া হয়, তাতে পোলাও, ডিম, খেজুর, পেঁয়াজু, ছোলা দেওয়া হয়।
ইফতারি নিতে আসা লোকদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য হাতমাইক নিয়ে অনুরোধ করছিলেন নাসিম চৌধুরী। অন্যদিকে ইফতারি বিতরণে কাজটি করছিলেন সংগঠনের অন্যরা। নাসিম চৌধুরী জানালেন, কয়েকজন বন্ধু মিলেই মানুষের পাশে থাকার এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁরা। তখন সবাই শিক্ষার্থী ছিলেন। এখন কেউ ব্যবসা, কেউ চাকরি, কেউবা আছেন প্রবাসে। তাঁদের মধ্যে মাহফুজুর রহমান, আদিব সারজিন, সাইফুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, আকমল হোসেন আছেন। তাঁদের কার্যক্রমে শিক্ষার্থী ইফতেখার সাজ্জাদ, মাহফুজ সিয়াম, মাহবুব হাসানসহ আরও কয়েকজন সহযোগিতা করেন।
নাসিম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নিজেরাই অর্থ দিয়ে প্রথমে শুরু করেছিলাম। এখন দেশে-বিদেশের অনেকেই সহযোগিতা করছেন। অনেকে উৎসাহ দেন। এটি এমন বড় কোনো কাজ নয়, তবু আমরা একধরনের তৃপ্তি পাই।’
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সুনামগঞ্জের সদস্য ও আইনজীবী আইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর থেকে দেখছি এই তরুণেরা উদ্যোগ নিয়ে শহরের হতদরিদ্র মানুষজনের জন্য ইফতারির ব্যবস্থা করছেন। তাঁদের মানবিক কাজগুলো দেখে খুব ভালো লাগে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ।’