গত এক মাসে চারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। যাত্রীদের অভিযোগ, বারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হলেও রেল কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ থেকে প্রতিদিন সকালের ট্রেনে সান্তাহার এসে অফিস ধরেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম। অফিস শেষে রাতের ট্রেনে আবার গাইবান্ধায় ফিরে যান। গত রোববারও সান্তাহার থেকে বোনারপাড়াগামী ‘ফোর নাইনটি ওয়ান কলেজ ট্রেনে’ মহিমাগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তিনি। ট্রেনটি রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বগুড়ার গাবতলী রেলস্টেশনে পৌঁছানোর আগেই ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি নিয়ে লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা আটকে থাকেন নুরুল ইসলাম।
ট্রেন লাইনচ্যুতির পর শুধু নুরুল ইসলাম আটকে পড়েননি। উত্তরবঙ্গগামী সব ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লালমনিরহাট থেকে আসা সান্তাহারগামী ‘পদ্মরাগ এক্সপ্রেস’ ও বুড়িমারী থেকে ছেড়ে আসা সান্তাহারগামী ‘করতোয়া এক্সপ্রেস’ ট্রেনের হাজারো যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর উদ্ধারকারী ট্রেন এসে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনটি উদ্ধার করলে রেলপথ সচল হয়।
ওই ঘটনার মাত্র দুই দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার আবার বিড়ম্বনায় পড়েন নুরুল ইসলাম। মঙ্গলবার সকালে মহিমাগঞ্জ থেকে ‘কলেজ ট্রেনে’ সান্তাহার রওনা দিয়ে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে বগুড়ার সুখানপুকুর রেলস্টেশনে উঠতেই দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়। বগি উদ্ধারে দেরি হওয়ায় প্রায় তিন ঘণ্টা পর লাইনচ্যুত দুটি বগি রেখে ট্রেনটি গন্তব্যে যায়। সকাল ১০টায় অফিসে থাকার কথা থাকলেও নুরুল পৌঁছান বেলা একটায়।
সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলপথে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে। এক মাসের ব্যবধানে এ রেলপথে চারটি ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীদের অভিযোগ, বারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হলেও রেল কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও তাঁদের দীর্ঘক্ষণ আটকে থেকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, লালমনিরহাট-সান্তাহার রেলপথে প্রতিদিন আটটি ট্রেন চলাচল করে। গত এক মাসে এ রেলপথে লাইনচ্যুত হওয়া চারটি ট্রেনের মধ্যে ‘কলেজ ট্রেন’ লাইনচ্যুত হয়েছে তিনবার। রোববার ও মঙ্গলবারের দুর্ঘটনার আগে গত ২৫ জুন সকালে সুখানপুকুর রেলস্টেশনের কাছে ট্রেনটির তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ঢাকার সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। তার আগে গত ২৯ মে বেলা পৌনে তিনটায় সান্তাহার থেকে আসা লালমনিরহাটগামী ‘উত্তরবঙ্গ মেইল’ ট্রেনের একটি বগি কাহালু স্টেশনের অদূরে লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সব ধরনের রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল।
দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের যাত্রী রুয়েল মিঞা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রোববার রাতে সান্তাহার থেকে কলেজ ট্রেনে তিনি সোনাতলায় যাচ্ছিলেন। রাত পৌনে ৯টার দিকে গাবতলী স্টেশনের ১ নম্বর লাইন থেকে ২ নম্বর লাইনে প্রবেশের আগমুহূর্তে আচমকা ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়। আতঙ্কে যাত্রীরা ট্রেন থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে কয়েকজন আহত হন। তিনি বলেন, লোডশেডিং থাকায় ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে তাঁদের আটকে থাকতে হয়।
আটকে পড়া রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী মোস্তফা ফয়সাল বলেন, ঢাকা-সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলপথে প্রায়ই ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। পুরোনো রেলপথ আধুনিকায়নে কর্তৃপক্ষ উদাসীন। এ ব্যাপারে তাদের তদারকি দরকার। ‘পদ্মরাগ এক্সপ্রেসের’ যাত্রী মানিক হোসেন বলেন, দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হলেও রেল এখনো মান্ধাতা আমলের। সান্তাহার থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত রেলপথ এখনো মিটারগেজ। লক্করঝক্কর ট্রেনের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
ঘন ঘন লাইনচ্যুতির বিষয়ে বগুড়া রেলস্টেশনের মাস্টার সাজেদুর রহমান বলেন, রেললাইনের ত্রুটি, পুরোনো স্লিপার, ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগিতে ত্রুটি, নির্ধারিত গতিসীমার চেয়ে বেশি গতিতে ট্রেন চালানো, ভারী বৃষ্টির কারণে মাটি নরম হয়ে রেলপথ দেবে যাওয়ার কারণে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে।
লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে করা রেলপথগুলোর সংস্কার দরকার। ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা নানা কারণে ঘটে। গত এক মাসে সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলপথে চারটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনার পরপরই আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, কলেজ ট্রেন ও পদ্মরাগ এক্সপ্রেসের মতো ট্রেনের কোচগুলো ব্রিটিশ আমলের। যাত্রীদের সুরক্ষায় নিয়মিত রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি নতুন কোচ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
রেল–নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি নাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার রেলের ভাড়া বাড়ালেও রেলকে লোকসানি খাতে পরিণত করেছে। সরকার দূরত্বভিত্তিক রেয়াত বাতিল করে যাত্রীদের ওপর ভাড়া বৃদ্ধির জুলুম চাপিয়ে দিয়েছে। এতে শতকরা ৩০ ভাগ ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু রেলের উন্নয়নে তেমন কিছুই হয়নি।