জেলার রাজনীতি—১৬: চট্টগ্রাম উত্তর

দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হচ্ছে দুই দলেই

৭ আসনের ৪টিতে আ.লীগে মনোনয়ন লড়াই। বিএনপিতে কমিটি নিয়ে বিরোধ, একাধিক পক্ষ।

নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আসন ঘিরে নানামুখী বিরোধ চাঙা হচ্ছে। এই বিরোধের মূলে রয়েছে দলীয় মনোনয়ন। উত্তরের মোট সাতটি আসনের মধ্যে চারটিতে সরকারি দলে নিজেদের প্রার্থীদের সঙ্গে মনোনয়নের লড়াই স্পষ্ট। হাটহাজারী ও ফটিকছড়িতে শরিকদের সঙ্গে লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটিতে বিরোধ নেই।

একইভাবে আন্দোলনের পাশাপাশি উত্তরের আসনগুলোতে প্রার্থিতা ঘিরে এখন বিএনপির বিরোধ আরও চাঙা হচ্ছে। বিএনপির মধ্যে একাধিক পক্ষ গড়ে উঠেছে। একজনের নেতৃত্ব অপরজন মানছেন না। ভেতরে-ভেতরে মনোনয়নের দ্বন্দ্বও সামনে চলে আসছে ক্রমেই। তবে দলীয় নেতারা প্রকাশ্যে বলছেন, তাঁরা এখন আন্দোলনে রয়েছেন। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য সরকার পতন।

মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড় আ.লীগে

চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন। এখানে নিজেদের বিরোধ ক্রমেই জেঁকে বসছে। তবে মোশাররফ হোসেন আর নির্বাচন করবেন না বলে দুই বছর ধরে বলে আসছেন। গত শুক্রবার মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশেও তিনি নতুনদের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেন।

তবে এখানে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে মোশাররফ হোসেনের বিরোধ দীর্ঘদিনের। নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ। যুবলীগের সদস্যপদ পাওয়ার পর মিরসরাইয়ে তিনি একটা অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছেন। গত ১৭ জুন উপজেলার মঘাদিয়া এলাকায় তাঁর গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বর্তমান সংসদ সদস্য। এ আসনের দিকে চোখ জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলামের। ফটিকছড়ির প্রয়াত সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ারও মনোনয়নপ্রত্যাশী। আবার প্রবীণ পেয়ারুল ইসলামেরও এলাকায় একটি শক্ত ভিত রয়েছে। একসময় রফিকুল আনোয়ারের সঙ্গে পেয়ারুল ইসলামের মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল।

পেয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফটিকছড়ি আসনে সবাই দলীয় প্রার্থী আশা করছেন। তবে নৌকার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ। আমরা এখানে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসা করে চলেছি।’

চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি আলাউদ্দিন বেদন ও সাধারণ সম্পাদক মাঈনুদ্দিন মিশনের সম্পর্ক ভালো। তবে সাবেক মেয়র জাফরুল্লাহ টিটোর সঙ্গে মাহফুজুর রহমানের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এই দ্বন্দ্বে নতুন যুক্ত হয়েছেন মাইটভাঙা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উত্তর জেলা যুবলীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমান। মনোনয়ন নিয়ে এখানে বিরোধ ক্রমেই চাঙা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসন ঘিরেও মনোনয়নের দ্বন্দ্ব জেগে উঠেছে। এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল বাকের ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুনের মধ্যে আগে থেকেই আধিপত্য নিয়ে বিরোধ রয়েছে। দুজনই এবার মনোনয়নপ্রত্যাশী। বর্তমান সংসদ সদস্য দিদারুল আলম স্বতন্ত্র একটা অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছেন। মূলত এই তিনজনের মধ্যে বিভক্তি বিরাজমান।

চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে ২০০৮ সাল থেকে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সংসদ সদস্য। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম তখন থেকেই এখানে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। পরে তাঁকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয়। এবারও তিনি মনোনয়ন চাইবেন। একই কমিটির নির্বাহী সদস্য ইউনুস গনি চৌধুরীও একই আশায় বুক বাঁধছেন। তিনি ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এম এ সালাম সম্পর্কে বিষোদ্‌গার শুরু করেছেন।

এম এ সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার হাটহাজারীতে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী না দিলে আমরা অবরোধ করব। আওয়ামী লীগের যাকে দেবে দিক, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।’

চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন না। তাঁর বিরোধী হিসেবে পরিচিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুসলিম খান, উত্তর জেলার যুগ্ম সম্পাদক দেবাশীষ পালিত ও আবুল কালাম আজাদ এলাকায় যেতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাউজান পৌরসভার সাবেক মেয়র দেবাশীষ পালিত বলেন, এখানে একক ব্যক্তির ইচ্ছা দ্বারা রাজনীতি চলছে। বাক্‌স্বাধীনতা নেই। ফলে
অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারছেন না।

চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কোনো বিরোধ নেই। এখানে হাছান মাহমুদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আপাতত দেখা যাচ্ছে না। সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে সবাই ঐক্যবদ্ধ বলে দাবি করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম।

বিএনপিতে বিভক্তি

দীর্ঘদিন ধরে কোন্দলে জর্জরিত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি। এ কারণে কমিটিতে সদস্যসচিবও কাউকে রাখা হয়নি। আহ্বায়ক কমিটি তিন মাসের জায়গায় তিন বছরেও কমিটি গঠন করতে পারেনি। উল্টো চারটি পক্ষে বিভক্ত এখন নেতা–কর্মীরা। একসময় বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত উত্তর চট্টগ্রামের সাতটি উপজেলার মধ্যে দু-একটি ছাড়া বাকিগুলোতে দলীয় কর্মসূচি পালিত হয় নামমাত্র।

আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সাতটি সংসদীয় আসনে মনোনয়ন ঘিরে কর্মীদের বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশের বিরোধিতার মুখে ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকারকে। এই কমিটি কোন্দল থামাতে পারেনি, উল্টো বেড়ে যায়। সর্বশেষ কোন্দল নিরসনে নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমানের সঙ্গে পরামর্শ এবং মতামতের ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তাঁর ভাতিজা হুম্মাম কাদের চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও তাঁর ছেলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলাল, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার, প্রয়াত সংসদ সদস্য সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে শাকিলা ফারজানার অনুসারীরা আলাদা আলাদা বলয়ে বিভক্ত হয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করে আসছেন।

৩ অক্টোবর রোডমার্চ কর্মসূচি সফল করতে প্রস্তুতি সভায়‍ নাসিমন ভবনে দলীয় কার্যালয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক ও নির্বাহী কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সভায় টানানো ব্যানারে তাঁদের নাম না থাকায় দুজনের অনুসারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন তাঁরা।

উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কমিটি করতে না পারায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যায়নি। দলে কোনো বিরোধ নেই। সরকার পতনের আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ।

চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে মনোনয়ন–দৌড়ে আছেন বিএনপির তিন নেতা। গতবার দলের মনোনয়ন পাওয়া উত্তর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন (চেয়ারম্যান), উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহিদুল ইসলাম চৌধুরী এবং আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক, তাঁর নামও নুরুল আমিন।

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে বিএনপির চারজনের নাম বেশি শোনা যাচ্ছে। তাঁরা হলেন হুম্মাম কাদের চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আজিম উল্লাহ বাহার ও উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সরোয়ার আলমগীর। চারজনেরই আলাদা পক্ষ রয়েছে।

চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মোস্তফা কামাল পাশা মনোনয়ন–দৌড়ে আছেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে একক প্রার্থী কারাবন্দি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। তাঁর প্রতি দলের প্রায় সব স্তরের নেতা-কর্মীর আস্থা রয়েছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে দলীয় পদ নিয়ে জেলা বিএনপির সদস্য জহুরুল আলম ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী সালাউদ্দিনের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে।

চট্টগ্রাম-৫ হাটহাজারী আসনে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হক ও প্রয়াত সংসদ সদস্য সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম চৌধুরীর মেয়ে শাকিলা ফারজানা মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁদের আলাদা আলাদা পক্ষ রয়েছে। একজন মনোনয়ন পেলে অন্যরা বেঁকে বসতে পারেন।

চট্টগ্রাম-৬ (রাউজানে) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তাঁর ছেলে সামির কাদের চৌধুরী, আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী এবং তাঁর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর নাম আলোচনায় আছে।

চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও তাঁর মা ফরহাত কাদের চৌধুরী। হুম্মাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ও তাঁর মা রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়িতে মনোনয়ন চাইবেন। দল যেখানে দেয়, সেখান থেকে নির্বাচন করবেন তাঁরা।

বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান বলেন, ‘নির্বাচন, মনোনয়ন নিয়ে আমরা এখন ভাবছি না। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোই একমাত্র লক্ষ্য।’