দুই প্রার্থীর কারণে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কয়েকটি ঘটনায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
মানিকগঞ্জ-২ (সিঙ্গাইর-হরিরামপুর-সদরের একাংশ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগম ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে হুমকি, সংঘর্ষ, নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ এবং একাধিক মামলার ঘটনায় এই আসনে নির্বাচনী পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
মমতাজ বেগম নৌকা প্রতীকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। এবারও তাঁকে বেছে নিয়েছে দল। মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদ। শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন দেওয়ান জাহিদ। তাঁর প্রতীক ট্রাক।
এ ছাড়া আসনটিতে আওয়ামী লীগের আরও তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। তাঁরা হলেন দেওয়ান সফিউল আরেফিন ওরফে টুটুল (মোড়া), মুশফিকুর রহমান খান (কেতলি) ও সাহাবুদ্দিন আহমেদ (ঈগল)। এ ছাড়া অন্যান্য দল মিলে এই আসনে মোট ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছাড়া কারও তেমন প্রচারণা নেই।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে এবং তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার পর থেকে মমতাজ ও জাহিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয় এবং তা প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সহসভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নেতা-কর্মীরা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। সংঘর্ষ, হামলা, হত্যার হুমকিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত রোববার বিকেলে হরিরামপুর উপজেলা সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অনুসারীরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলা করেন। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর তিন কর্মী আহত হন। পরদিন উপজেলা সদরে একই স্থানে দুই প্রার্থীর অনুসারীরা পৃথক মিছিল করেন। এতে সারা দিন উপজেলা সদরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করে।
এ ঘটনায় গত সোমবার হরিরামপুর থানায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদের দুই অনুসারী। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন নৌকার এক অনুসারী। এ ঘটনা নিয়ে হরিরামপুরে এখনো দুই প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে।
গত মঙ্গলবার ভোরে সিঙ্গাইর উপজেলার সায়েস্তা ইউনিয়নের বৈরাগীরটেক এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী অস্থায়ী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করা হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীরা এই অগ্নিসংযোগ করেন বলে অভিযোগ করেন নৌকার প্রার্থীর অনুসারীরা। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহম্মেদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নৌকার কর্মীরাই নিজেদের ক্যাম্পে আগুন দিয়ে তাঁদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন।
মঙ্গলবার বিকেলে সিঙ্গাইরের তালেবপুর ইউনিয়নের ইরতা গ্রামে দেওয়ান জাহিদের ট্রাক প্রতীকে ভোট চেয়ে ছোট পোস্টার (হ্যান্ডবিল) বিতরণ করছিলেন তাঁর অনুসারীরা। এ সময় মমতাজ বেগমের অনুসারী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলী ইস্কান্দার স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের গুলি করে হত্যা ও হাত কেটে নেওয়ার হুমকি দেন। এই ঘটনার ভিডিও বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
একই দিন সন্ধ্যায় হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি এলাকায় দেওয়ান জাহিদের কর্মী শাখাওয়াত হোসেনকে প্রাণনাশের হুমকি দেন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ ও নৌকার কর্মী সম্পাদক ফরিদ মোল্লা ও রিফাত চৌধুরী। এ ঘটনায় শাখাওয়াত বাদী হয়ে ফরিদ, রিফাতসহ অজ্ঞাত আরও ২০–২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
এসব ঘটনায় জেলার তিনটি আসনের মধ্যে মানিকগঞ্জ-২ আসনে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে দুই প্রার্থীর অনুসারীরা ততই মারমুখী হয়ে উঠছেন। এ বিষয়ে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন নেতা–কর্মীর সঙ্গে কথা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের ইঙ্গিত দেন তাঁরা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহম্মেদ বলেন, নির্বাচনে তাঁর অনুসারীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সাধারণ ভোটারদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে নির্বাচনী পরিবেশ অশান্ত হয়ে পড়ছে। তবে পাল্টা অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগম বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনই তাঁর পোস্টার ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলছে। মাইকিংয়েও বাধা দিচ্ছে। শান্ত পরিবেশ ঘোলাটে করছে।
নির্বাচন নিয়ে মানিকগঞ্জ-২ আসনে কিছুটা উত্তেজনা আছে স্বীকার করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) সুজন সরকার বলেন, যেকোনো সহিংসতা রোধে পুলিশের তৎপরতা রয়েছে। এই আসনে টহলরত পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। যে প্রার্থীর কর্মীই হোক, কেউ সহিংসতার চেষ্টা করলে ছাড় নয়। ইতিমধ্যে কয়েকটি ঘটনায় মামলা হয়েছে এবং আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযানও চলছে।