এখনকার পেস্ট্রি শপ-বেকারির দোকান মানেই বাহারি সাইনবোর্ড, বিজ্ঞাপন, চাকচিক্যময় সাজসজ্জা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বরিশাল নগরের হাজি ফকির চাঁন বেকারি। জরাজীর্ণ এই বেকারির নাম নগরের সবাই জানে। ১১০ বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল, এখনো ক্রেতার আস্থায় টিকে আছে দোকানটি।
নগরের মূল ব্যবসাকেন্দ্র চকবাজার। চকবাজারের দক্ষিণ দিকটায় এলে ব্রিটিশ শাসনামলের কিছু ছাপ এখানটায় দেখা যায়। লাল ইট-সুরকিতে ব্রিটিশদের নির্মিত সুউচ্চ ও অনন্য নির্মাণশৈলীর জেলা পরিষদ ভবন, পরিত্যক্ত ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরেট ভবন, পুরোনো দিঘিসহ আরও কিছু স্থাপনা আছে এখানে। একটু দূরেই বরিশাল নদীবন্দর। ১৮৮০ সালের আগে বরিশালের নদীপথে স্টিমার চলাচল শুরু করে। ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল সেন্ট্রাল ফ্লোটিলা কোম্পানি বরিশাল ও খুলনার মধ্যে নিয়মিত স্টিমার পরিষেবা চালু করে। পরে বরিশাল নদীবন্দরটি আন্তজেলা ও বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে কলকাতা পর্যন্ত উভয় পথে একটি টার্মিনাল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্টিমার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এসব ঘিরেই এই এলাকায় বরিশাল শহরের মূল প্রশাসনিক ও ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। ফকির চাঁন বেকারিও সেই ইতিহাসেরই স্মারক। হাজি ফকির চাঁনের মালিকানায় দক্ষিণ চকবাজারে এই জনপদের প্রথম বেকারি এটি। ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ সেনাদের পাউরুটি সরবরাহের জন্য প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল।
ছোট একটি দোকান। দোকানে সাজানো হরেক রকমের বিস্কুট, চানাচুর ও ছোট–বড় বনরুটি। আছে ফ্রুটস, মালটোভা, প্লেন ও চালকুমড়ার মোরব্বা কেক। প্রায় ৮০ ফুট লম্বা, ১৮ ফুট চওড়া এই বেকারি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ জমির ওপর গড়ে উঠেছিল। এর পরিসর আর বড় হয়নি। প্রথমে ছিল টিনের ঘর, এখন দোতলা পাকা ভবন হয়েছে; এটুকুই পরিবর্তন হয়েছে।
শুরু থেকে বেকারিটি রুটি ও বিস্কুট তৈরি করে আসছে। বর্তমানে এর প্রধান কারিগর শাহ আলম (৬০) জানালেন, তাঁর বাবা হাসান আলী এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। বাবার সঙ্গে তিনি আট বছর বয়সে এখানে কাজে যোগ দেন। বনরুটি ছাড়াও মিষ্টি, নোনতা ও টোস্ট—এই তিন ক্যাটাগরির ১৫ ধরনের বিস্কুট তৈরি হয় বেকারিটিতে। এ ছাড়া তিন ধরনের কেক এবং বিশেষ ধরনের চানাচুর ও পেস্ট্রি হয়। এখান থেকে বিস্কুট ও চানাচুর বিক্রি বেশি হয়। আগে দৈনিক ২৫ কেজি বিস্কুট বিক্রি হতো, এখন ৬০ কেজির মতো বিস্কুট বিক্রি হয়। আগে চানাচুর বিক্রি হতো ৩০ কেজি, এখন ৪৫ কেজির মতো বিক্রি হয়। তবে আগের চেয়ে বনরুটি বিক্রি কমেছে।
হাজি ফকির চাঁন ছিলেন ভারতের দিল্লির অধিবাসী। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল সুগন্ধি বিক্রি। ব্যবসার জন্য উনিশ শতকের শুরুতে ঢাকায় আসেন। এরপর বিয়ে করে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থিতু হন। সুগন্ধির ব্যবসায় মন্দা হওয়ায় তিনি ব্যবসার ধরন পাল্টানোর চেষ্টা করেন। পরে চলে আসেন বরিশালে। বরিশালে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ সেনাদের পাউরুটি সরবরাহের কাজ পান। একদিন ব্রিটিশ সেনারা তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি নিজে এসব রুটি তৈরি করেন কি না। ফকির চাঁন বাইরে থেকে কিনে আনার কথা জানালে তাঁরা তাঁকে কারখানা স্থাপনের উৎসাহ দেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ জমি ইজারা দেয় নগরের দক্ষিণ চক বাজারে। সেখানে তিনি ‘ফকির চাঁন বেকারি’ শুরু করেন। এটা ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যকার ঘটনা।
পরিবার নিয়ে হাজি ফকির চাঁন বরিশালে থাকতে শুরু করেন। দুই ছেলে হাজি বরকত উল্লাহ ও হাজি আবদুল মজিদ বাবার ব্যবসার সঙ্গেই ছিলেন। একসময় পৈত্রিক ব্যবসার ভার পড়ে বড় ছেলের ওপর। ছোট ছেলে ঢাকায় ভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন। বরকত তাঁর একমাত্র ছেলে আবুল খায়েরকে এই ব্যবসার উত্তরসূরি করার কথা ভেবেছিলেন। আবুল খায়ের ১৯৮০ সালে ক্যানসারে মারা যান। তাঁর একমাত্র ছেলে আহমদুল্লাহ রাকিবের বয়স তখন মাত্র দেড় বছর। বরকত উল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী জাহানারা বেগম পারিবারিক এই ব্যবসা আহমদুল্লাহ রাকিবের নামে আইনিভাবে দিয়ে দেন। এখন তিনিই প্রতিষ্ঠানটির মালিক।
আহমদুল্লাহ রাকিব এখন ঢাকায় থাকেন। সেখান থেকেই ব্যবসার দেখাশোনা করেন। মাসে দুবার বরিশালে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে আমাদের কাছে ব্যবসাটা মূল নয়, পূর্বপুরুষের সুনামটা মুখ্য। আমরা তাই মানের সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করিনি, করবও না। আমরা পণ্য তৈরিতে বাজারের সবচেয়ে ভালো জিনিস ব্যবহার করি। বিস্কুট তৈরিতেও আমরা খাঁটি ঘি ব্যবহার করি। এসব কারণে আমাদের পণ্য অন্যদের থেকে গুণে–মানে আলাদা, সুস্বাদু।’
ছোট পরিসরের দোকানটির মাঝ বরাবর খোপকাটা একটা অপরিসর দরজা। এই দরজা দিয়েই পেছনে যাওয়া যায়। পেছনেই মূল কারখানা। কারখানা থেকে পণ্য তৈরি করে দোকানে তোলা হয়। কারখানার ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, শতবছরের পুরোনো কাঠের পাত্রে বিস্কুট, রুটি তৈরির খামির। বড় চুল্লির ভেতর থেকে টিনের ট্রেতে করে নামানো হচ্ছে বিস্কুট-কেক। কেউ চুল্লি থেকে বিস্কুট তুলছেন, কেউ টিনের ট্রেতে ভরছেন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তাজা বিস্কুটের ম ম সুগন্ধ।
এখানে আমাদের কাছে ব্যবসাটা মূল নয়, পূর্বপুরুষের সুনামটা মুখ্য। আমরা তাই মানের সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করিনি, করবও না।আহমদুল্লাহ রাকিব, মালিক, হাজি ফকির চাঁন বেকারি
দোকানের ব্যবস্থাপক তোতা মিয়া এখানে কাজ করছেন অর্ধশতাব্দী ধরে। তিনি বলেন, ‘আমরা সব মিলিয়ে এখানে ১৮ জন কাজ করি। আমাদের বিক্রি কমেনি, বরং চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে লাভ কমেছে। কারণ, এখন সব জিনিসের দাম চড়া। এসব কারণে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। লাভ কম হলেও আমরা মান কমাইনি। এই নীতিতে কোনো আপস নেই। এ জন্যই ফকির চাঁন বেকারি এখনো টিকে আছে।’
তোতা মিয়া বলেন, ‘আমাদের পাউরুটি বানানোর এক ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। অন্যান্য পণ্যও দ্রুত ফুরিয়ে যায়। প্রতিদিনের পণ্য আমরা চাহিদার হিসাব করে বানাই। কোনো বাসি পণ্য আমরা বিক্রি করি না। সবই টাটকা।’