সিলেট সিটি নির্বাচনে ইভিএমের ধীরগতিতে ভোগান্তি, ভোট পড়েছে ৪৫ শতাংশ

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন নারী ভোটাররা । আজ বেলা একটায় হযরত শাহপরান উচ্ বিদ্যালয়ে
 ছবি: প্রথম আলো

বৃষ্টির আশঙ্কা থাকলেও হয়নি। তবু ভোটারের উপস্থিতি ছিল কম। ভোট গ্রহণেও ছিল ধীরগতি। আজ বুধবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা এ ভোট গ্রহণ চলে। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগসহ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট গ্রহণ ছিল শান্তিপূর্ণ।

ভোট চলাকালে অধিকাংশ কেন্দ্রে ইভিএম জটিলতায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভোটারদের। ধীরগতির এ ভোটের কারণে অনেক ভোটারই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এমনকি একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়ে পড়ায় ৪০ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল। এ ছাড়া অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি।

এদিকে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর যোগাযোগ করা হয় সিলেটের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও সিটি নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের গণমাধ্যম শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারেক আহমদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম ৫ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। এরপরের ৩ ঘণ্টায় ভোট পড়ার হার বেড়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সিলেটে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে ফলাফল হাতে না আসা পর্যন্ত চূড়ান্ত কিছুই বলা যাবে না।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪২ ওয়ার্ডের ১৯০টি কেন্দ্রে ভোট হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রথম আলোর চারজন প্রতিবেদক ও দুজন ফটোসাংবাদিক ৩৮টি কেন্দ্র ঘুরে দেখেন। এসব কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী অসংখ্য তরুণ-যুবককে অবস্থান নিতে দেখা যায়। কেন্দ্রের ভেতরে দিব্যি ঘোরাফেরা করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁদের কোনো বাধা দিতে দেখা যায়নি।

ইভিএমে ধীরগতি, ক্ষুব্ধ ভোটার

৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের আখালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটকক্ষ ৯টি। ৬ নম্বর কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত আটজন নারী ভোটার অভিযোগ করেন, সকাল আটটা থেকে তাঁরা কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। ধীরগতিতে ভোট নেওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬ নম্বর কক্ষের মোট ভোটার ৩৭৮ জন। সকাল ৯টা ২৪ মিনিট পর্যন্ত ২২ জন এবং ৯টা ৪৬ মিনিট পর্যন্ত ৩২ জন ভোট দিতে পেরেছেন। এ হিসাবে একজন ভোটারের ভোট দিতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে চার মিনিট করে। এ সময় কক্ষের সামনে অন্তত শতাধিক ভোটার সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ভোটকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আখালিয়া কারিপাড়া এলাকার ভোটার গৃহিণী জোসনা বেগম (৩৩) অভিযোগ করেন, দুই ঘণ্টা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকার পরও ধীরগতির কারণে তিনি সকাল ১০টা পর্যন্ত ভোট দিতে পারেননি। একই সারিতে থাকা মদনমোহন কলেজের স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী তানজু আক্তার একই অভিযোগ করেন।

পরে ভোটকেন্দ্রটির অন্যান্য কক্ষ ঘুরেও ভোট গ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ পাওয়া যায়। এর কারণ হিসেবে ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট হওয়ায় অভিজ্ঞতার অভাবে অনেকে ভোট দিতে অসুবিধায় পড়েছেন। অধিকাংশ ভোটার ভোট দিতে কমপক্ষে পাঁচ–সাত মিনিট সময় নেন। এ ছাড়া অধিকাংশ কক্ষ অন্ধকার থাকায় ভোট নিতে প্রতিবন্ধকতা হয়। এতে পর্যাপ্ত ভোটারের উপস্থিতি থাকলেও ভোট গ্রহণে বিলম্ব হয়।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের সামনে ফলাফলের অপেক্ষায় প্রার্থীদের কর্মী-সমথকেরা স্লোগান দেন। দোহর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শাহজালাল ইসলামিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র

৯ নম্বর কক্ষের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তানিম চৌধুরী জানান, তাঁর কক্ষে মোট ভোটারের সংখ্যা ৩৭৯। এর মধ্যে প্রথম দেড় ঘণ্টায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৭টি। যদিও এ কক্ষের সামনে অন্তত শতাধিক নারীকে এ সময় ভোট দেওয়ার জন্য সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

বালুচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলেট সরকারি মডেল স্কুল, বীরেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ইভিএমে অভ্যস্ত না হওয়ার কারণে ভোট গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে। এ ছাড়া ইভিএম বিকল হয়ে পড়ায় আখালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৩ নম্বর কক্ষে ভোট গ্রহণের পর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত অন্তত ৪০ মিনিট ভোট গ্রহণ বন্ধ ছিল।

সিলেট সরকারি মডেল স্কুল কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সরোজ কুমার হালদার বলেন, ইভিএমের কারণে ভোট গ্রহণে কিছুটা দেরি হয়। তবে ইভিএমে ভোট দিতে ভোটারদের কোনো সমস্যা হয়নি।

গোপন কক্ষে বারবার নৌকার এজেন্টের উঁকি

আখালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ৬ নম্বর ভোটকক্ষে থাকা নৌকার এজেন্ট মো. আজাদ মিয়া বারবার ভোটদানে সহযোগিতা করার কথা বলে ওই বুথের গোপন কক্ষের পাশে গিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন। সকাল ৯টা ২৪ মিনিটে ওই কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, এক নারী পরপর অন্য তিন নারী ভোটারের সঙ্গে গোপন কক্ষে ঢুকে ব্যালট প্যানেলের বাটনে চাপ দিয়ে ভোট দেন। পুরো বিষয়টি পাশে দাঁড়িয়ে তদারক করছিলেন নৌকার এজেন্ট আজাদ মিয়া।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওই কক্ষে দায়িত্বরত সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মনিকা রায় বলেন, বয়স্ক মানুষ হওয়ায় ওই তিন নারী ভোটার ইভিএমে ভোট দিতে পারছিলেন না। তাই বিষয়টি দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ওই ভোটারদের মতামত নিয়েই তাঁদের আত্মীয় ওই নারীকে গোপন কক্ষে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

নৌকার এজেন্টের দখলে কেন্দ্র

দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কেন্দ্রগুলোতে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। তবে সব কেন্দ্রে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্ট পাওয়া গেছে।

৮ নম্বর ওয়ার্ডের বীরেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের ৭ নম্বর কক্ষে দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে কোনো মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। ওই কক্ষে থাকা নৌকার এজেন্ট সামিয়া রশিদ নিশাত জানান, তিনি ছাড়া অন্য কোনো মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট এখানে নেই। তবে পুরুষ ও নারী কাউন্সিলরদের আটজন এজেন্ট আছেন। আখালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ছাড়া অন্য কারও এজেন্ট পাওয়া যায়নি।

প্রথম আলোর চারজন প্রতিবেদক ও দুজন ফটোসাংবাদিক ৩৮টি কেন্দ্র ঘুরে প্রতিটি কক্ষেই নৌকার প্রার্থীর এজেন্টের সন্ধান পেয়েছেন। কিছু কিছু কেন্দ্র ছাড়া লাঙ্গল কিংবা অন্য প্রতীকের এজেন্ট দেখা যায়নি।

এদিকে সকালে আনন্দ নিকেতন কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জাতীয় পার্টির মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল অভিযোগ তুলেছেন, সিলেটের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে লাঙ্গলের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা।

আজ সিলেট সিটি করপোরেশনে পঞ্চমবারের মতো ভোট গ্রহণ হয়। সকাল আটটা থেকে শুরু হওয়া এ ভোট বিকেল চারটায় শেষ হয়েছে। নগরের ৪২টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৩ জন। এখানে মেয়র পদে ৮ জন প্রার্থী থাকলেও বরিশাল সিটি নির্বাচনে দলের প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় সেদিন রাতে সিলেটের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এ ছাড়া সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর পদে এখানে ৩৫৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।