লালন স্মরণোৎসব উদ্বোধন

মায়ার টানে ছেঁউড়িয়ায় আখড়াবাড়িতে ভক্তদের ঢল

কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ায় শুরু হয়েছে তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব। এই উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে ভক্তদের ভিড়। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

আখড়াবাড়ির চত্বরে তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। লালন সাঁই যেখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন, ঠিক তার পাশে দেয়াল ঘেঁষে গান করছেন ষাটোর্ধ্ব ফকির আলতাব হোসেন সাঁই। কখনো বসে, আবার কখনো দাঁড়িয়ে গান গাইছেন তিনি। হাতে বাজছে একতারা। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ গানের তালে সুর মেলাচ্ছেন আগত দর্শনার্থীরাও।

গান শুনিয়ে আনন্দ পেলেন আলতাব হোসেন। বললেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাঘাইল গ্রাম থেকে তিনি এসেছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি সাঁইজির দীক্ষায় দীক্ষিত। ১৯৮৮ সাল থেকে নিয়মিত তিনি এই আখড়াবাড়িতে আসছেন। করোনাকালে দুই বছর আসতে পারেননি। গান শুনিয়ে তিনি বেশ আনন্দ পেয়েছেন।

মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আখড়াবাড়িতে শুরু হয়েছে লালন তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিন দিনের স্মরণোৎসব। হেমন্তের শুরুর দিনে গরমের তীব্রতা কম হলেও মানুষের ভিড়ে সরগরম পুরো আখড়াবাড়ি।

দুপুরের দিকে আখড়াবাড়িতে সরেজমিনে দেখা যায়, কুষ্টিয়া শহর থেকে যাওয়ার পথে আখড়াবাড়ির এক কিলোমিটার আগে থেকে সাধু, ভক্ত ও অনুসারীদের ঢল নেমেছে। শত শত মানুষ ছুটছেন আখড়াবাড়ি। মূল ফটকে পৌঁছাতেই ভিড় যেন আর সামনে এগোতে পারে না।

একতারা হাতে গান করছেন রাজশাহী থেকে আসা ষাটোর্ধ্ব আলতাব হোসেন সাঁই। মঙ্গলবার দুপুরে ছেঁউড়িয়া লালন আখড়াবাড়িতে

সাধু-ভক্তরা বলছেন, এ বছর উৎসব শুরুর দু-তিন দিন আগে থেকে প্রচুর মানুষ আসছে। শুরুর দিনে পা ফেলার জায়গা ফাঁকা নেই। মায়ার টানে, আত্মার টানে সাধু-ভক্তরা ছুটে আসছেন ধামে। আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণ বাদ্যযন্ত্র ও গানে গানে মুখর হয়ে উঠছে।

লালন একাডেমি মিলনায়তনের নিচে আসন পেতেছেন প্রবীণ ফকির নহির শাহ। তাঁর পাশে বসেছিলেন জাপানি নাগরিক কানাকো সরস্বতী সিমিজু ও ফ্রান্সের নাগরিক দেবরাহ জান্নাত। কানাকো খালি কণ্ঠে বাংলায় স্পষ্ট করে গান ধরলেন, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়। পারে লয়ে যাও আমায়...।’

জাপানি কানাকো প্রথম আলোকে বলেন, ১৬ বছর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমানে একটি আশ্রমে তিনি যান। সেখানেই লালনের গান শোনেন। এরপর বাংলাদেশের ফকির নহির শাহের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই ১৬ বছরে এবারই প্রথম তিনি লালনের কোনো অনুষ্ঠানে এসেছেন। এসে তাঁর খুবই ভালো লাগছে জানিয়ে বললেন, লালনের গান হৃদয় আন্দোলিত করে। কাঁপিয়ে তোলে। এ এক মধুর কথা, মধুর সুর।

কুষ্টিয়ায় লালন স্মরণোৎসবে দেখা মিলল জাপান ও ফ্রান্সের দুই নাগরিকের। তাঁরা লালন অনুসারী। লালনের গানও গাইতে পারেন। মঙ্গলবার দুপুরে ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়িতে

ফরাসি দেবরাহ অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরে কুষ্টিয়া দৌলতপুর উপজেলা প্রাগপুরে নহির শাহের ধামে থাকেন। তিনি নিয়মিত আখড়াবাড়িতে আসেন। তিনি দাবি জানান, বছরের দুটি উৎসবের এক-দেড় মাস আগে যেন সাধু–বাউলদের নিয়ে মতবিনিময় বৈঠক করা হয়। এতে নানা সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরা সম্ভব হয়। এ ছাড়া এই আখড়াবাড়িতে উৎসবে আসার পর কিছু সমস্যা থাকে, যেগুলো বলার জন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলো সমাধান করা প্রয়োজন।

সন্ধ্যা ছয়টায় লালন একাডেমির আয়োজনে আখড়াবাড়ির বাইরে কালী নদীর পাড়ঘেঁষা মূল মঞ্চে তিন দিনের আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। জেলা প্রশাসক এহেতেশাম রেজার সভাপতিত্বে সেখানে অতিথিরা বক্তব্য দেন।

কুষ্টিয়ায় লালন স্মরণোৎসবে তিল ধারণের জায়গা নেই। মঙ্গলবার দুপুরে আখড়াবাড়ির চত্বরে

বাউল ও লালন একাডেমির শিল্পীরা সেখানে মধ্যরাত পর্যন্ত লালনের গান পরিবেশন করেন। কালী নদীর তীরে বিশাল মাঠে শতাধিক অস্থায়ী দোকান বসেছে। গান শোনার ফাঁকে সেখানে মানুষ কেনাকাটা করছেন।

১৮৯০ সালের ১ কার্তিক লালন সাঁই কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। এর পর থেকে আখড়াবাড়ি চত্বরে তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা তাঁদের সাঁইজিকে স্মরণ করে আসছেন। লালন একাডেমি প্রতিবছর ছেঁউড়িয়ায় একাডেমি চত্বরে লালন স্মরণোৎসবের আয়োজন করে।