বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক পদে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ইন্টার্ন চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীরা। হাসপাতালে চিকিৎসা থেকে শুরু করে পদে পদে দুর্নীতি বন্ধ, চিকিৎসার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা দূর করে গরিব-অসহায় রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে তাঁরা এই দাবি তুলেছেন।
এই দাবির পক্ষে হাসপাতাল ক্যাম্পাসে ব্যানার ও পোস্টার সাঁটিয়েছেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের পাঁচ সদস্যের একটি দল ১ অক্টোবর স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের দাবির কথা তুলে ধরেন।
গতকাল বুধবার বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন দেয়ালে পোস্টার ও এই দাবিসংবলিত ব্যানার দেখা যায়। এ সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, হাসপাতালটি এ অঞ্চলের সরকারি চিকিৎসার শেষ ভরসাস্থল। বিশেষ করে হাজার হাজার গরিব ও সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবার জন্য এই হাসপাতালে আসেন। কিন্তু এই হাসপাতাল ঘিরে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় একটি বড় দালাল চক্র গড়ে উঠেছে, যারা হাসপাতালের পরিচালক থেকে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই চক্র কয়েক যুগ ধরে হাসপাতালটিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। এই চক্রের কাছে রোগীরা প্রতিনিয়ত জিম্মি থাকেন। এমন কোনো খাত নেই, যেখানে দুর্নীতি নেই। ফলে প্রতিনিয়ত রোগীরা অসহায় অবস্থার মধ্যে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। এই দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাট নিরসনে হাসপাতাল পরিচালনায় একজন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হলে এটা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা হাসপাতালে অনিয়মের বিষয়ে বলেন, জরুরি বিভাগে কোনো রোগী ভর্তি হওয়ার পর ট্রলিতে রোগীকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে নিতে অর্থ গুনতে হয়। আবার সেখানে শয্যা পেতে গুনতে হয় আরেক দফা অর্থ। চিকিৎসক স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ দিলে কর্মচারীদের যোগসাজশে দালাল চক্র ফুসলিয়ে বাইরের রোগ নির্ণয়কেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে গুনতে হয় অতিরিক্তি অর্থ।
শিক্ষার্থীরা জানান, এ অঞ্চলের সরকারি হাসপাতালে যত প্রসূতির সিজারিয়ান অপারেশন হয়, তার প্রায় ৯৭ শতাংশ হয় এই হাসপাতালে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অস্ত্রোপচার কক্ষ থেকে নবজাতককে বের করে আনতে হলে অভিভাবকদের গুনতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা বকশিশ।
শুধু তা–ই নয়, এই মেডিকেলে রোগী পরিবহনের জন্য সাতটি অ্যাম্বুলেন্সে থাকলেও সেগুলো সেবা দিচ্ছে না। কারণ, চালক আছেন মাত্র দুজন। ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা নতুন চালক নিয়োগ দেওয়ার দাবি তুললেও তা হয়নি। এ কারণে এখানে ব্যক্তিমালিকানার অর্ধশতাধিক অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে রোগী পরিবহন করা হচ্ছে। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে সুবিধা দিতে কাজ করছে এ চক্র। এরপর হাসপাতালের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছুই এ চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে। আর এসব চক্র গড়ে উঠেছে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির ও আউটসোর্সিং কর্মচারীদের নিয়ে। এর পেছনে থাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালকেন্দ্রিক অর্ধশত বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণের এই চক্রের নেতৃত্ব দিতেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক শীর্ষ নেতা। সরকার পতনের পর এখন তা নিয়ন্ত্রণ করছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার ভাই বিএনপির এক নেতা।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী আরাফাত রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে দুর্নীতি নেই। উদহারণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে জন্ম নেওয়া কোনো নবজাতকের মুখও টাকা ছাড়া দেখতে পারেন না মা–বাবা ও স্বজনেরা। পদে পদে দালালদের টাকা দিতে হয় এবং একটা সিন্ডিকেট পরিচালক থেকে শুরু করে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করে।’
আরাফাত রহমান আরও বলেন, ‘ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ ছিল। সেখানে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার পর সেবার মান আমূল পাল্টে গেছে। এমন উদাহরণ আরও আছে। তাই দক্ষিণাঞ্চলের সেবাপ্রত্যাশী কোটি মানুষের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনীর দক্ষ একজন ব্যক্তিকে এই হাসপাতালের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত। এ জন্য আমরা ১ অক্টোবর স্বাস্থ্য উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদের দাবির কথা তুলে ধরেছি। তাঁরা বিষয়টি দেখবেন বলে আমাদের আশ্বস্থ করেছেন।’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এইচ এম সাইফুল ইসলাম পদত্যাগ করেন। এর পর থেকেই সেনাবাহিনী থেকে পরিচালক নিয়োগের দাবি উঠেছে।
এমবিবিএস পঞ্চম ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত দিনগুলোয় দেখা গেছে, চিকিৎসকেরা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু তাঁদের এই চক্রের ওপর নির্ভর করেই সব কাজ করতে হয়েছিল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে সব পরিচালকই ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার আশীর্বাদপুষ্ট। ফলে তাঁরা ওই সিন্ডিকেটের আদেশ-নির্দেশ অনুসারেই নানা অনিয়ম-বিতর্কের জন্ম দিলেও হাসপাতালের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। এ জন্য এবার হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়ন, সিন্ডেকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ এবং দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে একজন সেনা কর্মকর্তাকে এই হাসপাতালের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়ার দাবি উঠেছে।
ইন্টার্ন চিকিৎসক হেদায়েত উল্লাহ বলেন, হাসপাতালে বিগত দিনে যেমন অনিয়ম, দুর্নীতি এবং চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতার চিত্র দেখা গেছে, তার পুনরাবৃত্তি কেউই চায় না। যেহেতু বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করে চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন ও সংস্কার হয়েছে, তাই শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একজন সেনা কর্মকর্তাকে পরিচালক পদে নিয়োগের দাবি উঠেছে।
জানতে চাইলে হাসপাতালের উপপরিচালক মনিরুজ্জামান শাহিন আজ বৃহস্পতিবার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে পোস্টার দেখেছি। এখন ছাত্ররা এখানে পরিচালক পদে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে চান। এটা চাইতেই পারেন, তাঁদের অধিকার। তাঁরা মনে করছেন, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাকে পরিচালক পদে নিয়োগ দিলে হাসপাতাল ভালো চলবে। এ জন্য এটা চাইছেন। এটা সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ার।’