নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে সংসার চালাতে কষ্টের কথা বলছেন কয়েকজন শ্রমিক ও দিনমজুর। সোমবার দুপুরে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদরের কলেজ গেট এলাকায়
নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে সংসার চালাতে কষ্টের কথা বলছেন কয়েকজন শ্রমিক ও দিনমজুর। সোমবার দুপুরে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদরের কলেজ গেট এলাকায়

‘দুধ-মাংস খাওন বাদ, তবু সংসার চলে না’

‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম খুব চড়া। চাল, ডাল, ডিম, দুধ, মাংসসহ হগল কিছুর দামই নাগালের বাইরে। যেই টেয়া আয় করি, হেইডা দিয়া সবকিছু কিনন যায় না। এগুলি ছাড়াও অন্যান্য খরচ আছে। বাসাভাড়া দিতে অয়। বাচ্চাগো লেহাপড়া ও কাপড়চোপড়ের খরচও আছে। টেয়ায় কূল পাই না। এলিগা দুধ, মাংস ও ডিম খাওন বাদ, তবু সংসার চলে না। গ্রামের বাড়িতেও টেয়া পাঠান লাগে। সব মিলে খুবই বেকায়দায় আছি।’

কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর রকিবুল ইসলাম (৩০)। নিত্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় সীমিত আয়ে সংসারের খরচ চালাতে কতটুকু হিমশিম খাচ্ছেন, তা বোঝাতে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা সদরের কলেজ গেট এলাকার একটি চায়ের দোকানে বসে সোমবার সকালে প্রথম আলোকে কষ্ট ও হতাশার কথা বলেন তিনি।

রকিবুলের বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়। তিনি কয়েক বছর ধরে মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ভবন নির্মাণের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। উপজেলার কলেজ গেট এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। গ্রামের বাড়িতে তাঁর পরিবার। সেখানে স্ত্রী, মা–বাবা ও তিন সন্তান আছেন।

উপজেলার কলেজ গেট এলাকায় কবির হোসেনের চায়ের দোকানে দ্রব্যমূল্যের হালচাল নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন রকিবুলসহ অন্তত ১০ জন শ্রমিক। চায়ের দোকানে রীতিমতো আলোচনার ঝড় তোলেন তাঁরা। সেখানে বসে রকিবুল ইসলাম আরও বলেন, প্রতিদিন কাজ করে ৬০০ টাকা পান। সরকার পরিবর্তনের পর এখন হাতে তেমন কাজ নেই। মাসের ১৫ দিন কাজ থাকে। ১৫ দিন বসে থাকতে হয়। মাসে গড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। ওই টাকায় বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল দিতে হয়। খাওয়া খরচ তো আছেই। এর ওপর বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। খরচ কমাতে নিজের ও পরিবারের খাদ্যতালিকা থেকে ডিম, দুধ ও মাংস বাদ দিয়েছেন। নিত্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় এরপরও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রায়ই টাকা ধার করতে হয়। সংসার নিয়ে খুব সমস্যায় আছেন তিনি।

রকিবুলের কথার রেশ শেষ না হতেই কথার পিঠে কথা টেনে সেখানে বসা দিনমজুর রাজু মিয়া বলেন, ‘আমার বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। ২২ বছর ধইরা এনো (মতলবে) আছি। তিন হাজার টেয়ার ভাড়া বাসায় থাকি। মাসে রুজি করি সাত–আট হাজার টেয়া। ঘরে খানেওয়ালা পাঁচজন। মাসে এক বস্তা চাল লাগে। মোটা এক বস্তা গুটি চাল কিনতেই লাগে প্রায় তিন হাজার টেয়া। টুকটাক সওদাপাতি কিনতে লাগে আরও কিছু টেয়া। এত কম রুজিতে মাংস, ডিম, দুধ কিনুম ক্যামনে। এগুলি বাদ দিয়াও সংসার চালাইতে পারি না। তিন মাস ধইরা মাংস, দুধ ও ডিম চোখে দেহি না। তরকারির দাম বেশি। হেনোও ভরসা নাই। চলুম ক্যামনে, চিন্তায় আছি।’

রাজু মিয়ার কথা শুনে চুপ থাকতে পারলেন না পাশে বসা রিকশাচালক নাসির উদ্দিন। তাঁর বাড়ি উপজেলার নবকলস এলাকায়। তিনি বলেন, রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই শ টাকা পান। শরীর খারাপ থাকলে সেদিন চালান না। মাসে গড়ে ২০ দিন গাড়ি চালান। এতে আয় হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। সে টাকায় মাছ-মাংস, ডিম-দুধ কিনে খাওয়া তো দূরের কথা, সবজি কেনাও যায় না। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছেন। বাজারে জিনিসপত্রের দাম না কমলে উপায় নেই। না খেয়েই মরতে হবে।

প্রায় একই রকম সমস্যা ও কষ্টের কথা বললেন ওই চায়ের দোকানে বসা নির্মাণশ্রমিক মো. রবিউল, মো. লিমন, সাজু মিয়া, রাজমিস্ত্রি মো. লিমন ও সালাম মিয়া, দিনমজুর নুরুল ইসলাম এবং ওই চায়ের দোকানি কবির হোসেনসহ কয়েকজন নিম্ন আয়ের মানুষ।

সোমবার দুপুরে উপজেলা সদর বাজার ঘুরে একাধিক ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে চাল, মাংস, ডিম, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম অনেকটা বেশি। প্রতি কেজি মোটা চাল ৬০ থেকে ৬২ টাকায়, প্রতি কেজি মাঝারি চিকন চাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়, প্রতি হালি ডিম ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়, প্রতি কেজি সোনালি মুরগি ৩২০ টাকায়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকায় এবং প্রতি লিটার দুধ ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা তরকারির দাম কিছুটা কমলেও তা এখনো অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি।