মোহাম্মদ সোহাগ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মন খারাপ তার। রোববার সকালে বেতবুনিয়া বাজার এলাকায়
মোহাম্মদ সোহাগ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মন খারাপ তার। রোববার সকালে বেতবুনিয়া বাজার এলাকায়

বিদ্যালয়ে যেতে না পেরে মন খারাপ ঘুমধুমের সোহাগের

মাঠে খেলা করছিল চার শিশু। পাশে দিয়ে আরেক শিশু মাদ্রাসায় যাচ্ছিল। চার শিশুর একজন মোহাম্মদ সোহাগ আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠল, ওমর মাদ্রাসায় যাচ্ছে। তার স্কুল বন্ধ বলে সে যেতে পারছে না। এ জন্য তার ভালো লাগছে না, মন খারাপ।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বেতবুনিয়া বাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে তুমব্রু বাজার যাওয়ার পথে গতকাল রোববার সকাল ১০টার দিকে সোহাগের এই কথা কানে আসে। গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলে মোহাম্মদ সোহাগ পরিচয় দেয় এভাবে, সে দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। তার মায়ের নাম নুর নাহার, বাবার নাম আবুল কাশেম। তার বাবা বেসরকারি একটি হাসপাতালে চাকরি করে। সীমান্তে প্রচুর গোলাগুলি হওয়ায় তাদের বিদ্যালয় বন্ধ আছে। আতঙ্কে কাটে তার সারাবেলা। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না।

শুধু সোহাগ নয়; চতুর্থ শ্রেণির তাসনিম হোসাইন ও দ্বিতীয় শ্রেণির মোহাম্মদ সালমানও জানাল একই কথা। তারা বিদ্যালয়ে যেতে চায়। আগের মতো পড়াশোনার পাশাপাশি হইহুল্লোড় করতে চায়।

৪ ফেব্রুয়ারি অঘোষিতভাবে বন্ধ থাকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বাইশফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমকূল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সব বিদ্যালয়ের অবস্থান সীমান্তের দুই কিলোমিটারের ভেতরে। পরের দিন ৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় এই পাঁচ বিদ্যালয় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত জানায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার পর্যন্ত সীমান্তের এই পাঁচ বিদ্যালয় বন্ধ আছে।

এ প্রসঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, একটু একটু করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি সীমান্ত এলাকা। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হলে পাঁচ বিদ্যালয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় জড়িত। তাঁরা যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

গতকাল ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেটের সামনে দেখা হয় চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিসা মুনতাহার সঙ্গে। সে জানাল, তাদের গ্রামে প্রচুর গুলি পড়েছে। সেগুলো নিয়ে তার বন্ধুরা খেলা করে। যখন গোলাগুলি হয়, তখন তার খুব ভয় হয়। তার বিদ্যালয়ে যেতে মন চায়, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে মন চায়।

তুমব্রু বাজার এলাকার এক অভিভাবক ছৈয়দুল আমীন (৪০) বলেন, ‘ওপারের সংঘর্ষের খেসারত দিচ্ছি আমরা। এক সপ্তাহ ধরে বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। আতঙ্কে ভুগছে। গুলি ও ভারী গোলাবর্ষণের শব্দ আমরা নিতে পারলেও শিশুরা নিতে পারে না।’

৫ ফেব্রুয়ারি ঘুমধুমের জলপাইতলী গ্রামে মর্টারশেল পড়ে নিহত হন হোসনে আরাসহ দুজন। এ সময় হোসনে আরার নাতনি নুশরাত মণি (৬) আহত হয়। নুশরাত মণির বাবা মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের চালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ে আতঙ্কে ভুগছে। গাড়ির শব্দ, হুইসেলের শব্দ পেলেই আঁতকে ওঠে।

বিদ্যালয় বন্ধ হলেও প্রতিদিন নানা কাজে বিদ্যালয়ে যেতে হয় বলে জানান তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হামিদুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে এসে বসে থাকে। অনেক সময় তাদের ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হয়। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক। তবে মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে। এতে নতুন করে আতঙ্ক ছড়ায়।