কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার পানির ফোয়ারার পূর্ব দিকে লামার বাজার সড়ক দিয়ে ১০০ গজ এগোলেই বাঁ পাশে প্রায় জরাজীর্ণ একটি দোতলা বাড়ি। বাড়িটির দোতলার বসার ঘরের চার দেয়ালে মার্কার কলমে ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে’, ‘নির্দোষ মানুষ কেন মরে?’, ‘আমাদের আব্বু হত্যার কি কোনো বিচার পাব না?’—এমন নানা কথা ও ছবি।
ছয় বছর আগে স্কুলপড়ুয়া তাহিয়াত হক ও নাহিয়ান হক তাদের বাবা একরামুল হক হত্যার বিচার চেয়ে দেয়ালে নানা প্রশ্ন লিখে রেখেছিল। ২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একরাম। আজ রোববার দেশব্যাপী আলোচিত এই ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হচ্ছে।
কিন্তু এসব দেয়াললিখন দেয়ালেই থেকে গেছে। জড় দেয়াল থেকে কোনো উত্তর মেলেনি। কলেজপড়ুয়া দুই বোন তাহিয়াত ও নাহিয়ান তাদের বাবার ও তাদের মা আয়েশা বেগম স্বামী হত্যার বিচার পাননি।
ভয়ে এখনো কোনো মামলা করতে পারেননি তিনি। তার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারলে তাঁর স্বামী হত্যার সুরাহা হবে।
আজ সকালে আয়েশা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয় বছর হলেও স্বামী হত্যার কিনারা হয়নি। দুই মেয়েকে বলতে পারি না তাদের বাবার খুনের বিচার কখন হবে। তারা তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো পায়নি।’ মামলা কেন করছেন না, তা জানতে চাইলে আয়েশা বেগম বলেন, ‘বেশি কিছু বলতে পারব না।
তবে এইটুকু জানি, আমাদের আরও বড় ক্ষতি হবে।’ তাহলে কি বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, বিচারের আশা ছাড়িনি। একজন জলজ্যান্ত মানুষকে ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করল, তার বিচার না চাই কেমনে।’
আয়েশা বেগমের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তাঁর স্বামী হত্যার একটি কিনারা হবে। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কিন্তু কেউ তাঁকে সেই সুযোগ করে দেননি। তবে এখন তিনি আবার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।
২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। ওই বছরের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন একরামুল হক।
ঘটনার সময় তিনি টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। ১২ বছর ছিলেন টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি।
একরাম তাঁর বাবার রেখে যাওয়া ৪০ বছরের পুরোনো বাড়ির এক কক্ষে থাকতেন। ব্যাংকে টাকাপয়সা নেই, ধারদেনা করে পৈতৃক ভিটায় বাড়ি তোলার কাজ শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে সেদিন সন্ধ্যায় যখন বের হন, তখন মোটরসাইকেলে তেল ভরার মতো টাকা ছিল না। বাসার উল্টো দিকের একটি হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করে বেরিয়েছিলেন।
একরামের স্বজনেরা জানান, হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে টেকনাফে গুজব ছড়িয়েছিল, একরামুল ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অনবরত একরামুলকে বিরক্ত করছিলেন। বারবার বলছিলেন, একরামুল যেন তাঁদের একখণ্ড জমি কেনায় সহযোগিতা করেন। তাঁদের চাপাচাপিতেই একরামুল বাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হন। জমির বিষয়টা ছিল অজুহাত।
শেষ কথোপকথনে যা ছিল
হত্যাকাণ্ড ঘটার সময় মেয়েদের সঙ্গে একরামুল হকের কথোপকথন শোনা যায় ফোনে থেকে যাওয়া রেকর্ডে। একরামের প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনে মেয়ে ফোন করলে চাপ পড়ে রিসিভ হয়ে যায়। একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগমের মুঠোফোনে রেকর্ড হয়ে যায় গুলির শব্দ, শোরগোল। এই অডিও ভাইরাল হলে ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে তখন।
একরাম যে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন, তার পাঁচ দিন পর আয়েশা কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করে একরামের সঙ্গে তাঁর ও মেয়েদের শেষ কথোপকথনের অডিও রেকর্ড প্রকাশ করেন। এর একটি অংশ
ছিল এ রকম:
মেয়ে: হ্যালো আব্বু!
একরাম: জি আম্মু। আম্মু আমি হ্নীলা যাচ্ছি।
মেয়ে: কেন?
একরাম: জরুরি কাজে যাচ্ছি। ...মেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, কেন?
একরাম: যাচ্ছি আম্মু...(কান্নার স্বরে কথা)।
মেয়ে: যাচ্ছ; তুমি কান্না করতেছ যে...?
এর কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ ও গোঙানির আওয়াজ শোনা যায়।
এই অডিও অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বাবা-মেয়ের শেষ কথোপকথন শুনে এবং একরাম নিহত হওয়ার খবরটি জেনে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে।
আয়েশা জানান, তখন সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু ছয় বছরেও সে ব্যবস্থা হয়নি। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আমার স্বামী মাদক ব্যবসায়ী নন। তালিকায়ও নাম নেই। টাকাপয়সাও নেই। তাহলে ইয়াবা ব্যবসায়ী হলেন কী করে?’
আয়েশা অভিযোগ করেন, ঘটনার পর র্যাব বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল, সেখানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির বাবার নাম-ঠিকানার সঙ্গে তাঁর স্বামীর বাবার নাম-ঠিকানার মিল নেই।
ঘটনার পর গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব লিখেছিল, ২৬ মে দিবাগত রাত ১টা ৫ মিনিটে র্যাব-৭-এর একটি চৌকস আভিযানিক দল কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার মেরিন ড্রাইভ এলাকায় অভিযান পরিচালনার সময় গুলিবিনিময়ের সময় যিনি নিহত হন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ইয়াবা গডফাদার টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. একরামুল হক কমিশনার (৪৬), পিতা মোজাহার মিয়া ওরফে আবদুস সাত্তার, নাজিরপাড়া, টেকনাফ পৌরসভা, টেকনাফ, কক্সবাজার।
আয়েশা বলেন, একরামুলের বাবার নাম মোজাহার মিয়া নয়, তাঁর ঠিকানাও নাজিরপাড়া নয়।
নাজিরপাড়া পৌরসভার বাইরে, সদর ইউনিয়নের একটি গ্রাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৭৩ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ১৮ নম্বরে নাম আছে এনামুল হকের, তাঁর বাড়ি নাজিরপাড়া, বাবার নাম মোজাহার মিয়া। এই এনামুল হকই প্রথম ২০১৮ সালের নভেম্বরে নিজেকে নিরপরাধ ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে ফিরতে চাই নিরাপদ জীবনে’। পরে তিনি আত্মসমর্পণ করেন।
বন্দুকযুদ্ধের পর টেকনাফ থানায় যে মামলা হয়, তাতে বলা হয়, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে একরাম মারা যান। ২০১৯ সালের ২৫ মে টেকনাফ থানার পুলিশ প্রথম আলোকে জানিয়েছিল, তদন্তে ঘটনার প্রমাণ না মেলায় মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
নিহত একরামের ছোট ভাই ও টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, দুই মাস ধরে ভাবি ও তাঁর দুই মেয়ে চট্টগ্রামে নানুর বাড়িতে রয়েছেন। তাঁরা কিন্তু এখনো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের অপেক্ষায় রয়েছেন।
একরামের পরিবার মামলা না করলেও বিভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। জানতে চাইলে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম আজ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কমিটির তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। যাবতীয় কাগজপত্রসহ তাঁকে ডাকার কথা ছিল, আর ডাকা হয়নি। তাঁর স্বামী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দল এত বছর ক্ষমতায় থাকারও পরও তাঁর স্বামী হত্যার বিচার না হওয়ায় হতাশ তিনি।
তবে এখনো হাল ছাড়েননি। তাঁর বিশ্বাস, একদিন কিছু হবে। সেই অপেক্ষায় আছেন তিনি।