টিসিবির পণ্য কিনতে মানুষের দীর্ঘ সারি। আজ বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট মোড়ে
টিসিবির পণ্য কিনতে মানুষের দীর্ঘ সারি। আজ বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট মোড়ে

টিসিবির ট্রাক সেল

সাড়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পরও পণ্য পেলেন না নিলুফা

তিন মাসের শিশু ঘরে রেখে বেলা সাড়ে ১১টায় পণ্য কেনার আশায় টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইনে দাঁড়ান গৃহিণী নিলুফা আক্তার। সারির ভিড় ঠেলে বেলা দুইটার দিকে কিছুটা সামনে এগিয়ে যান তিনি। এর মধ্যে ভিড়ও বাড়ে। মানুষের চাপে হঠাৎ ধাক্কাধাক্কিতে তিনি ছিটকে পড়েন সারি থেকে। পরে সারিতে দাঁড়িয়ে আর পণ্য পাননি। বেলা তিনটায় শেষ হয় পণ্য বিক্রি। সাড়ে তিন ঘণ্টার অপেক্ষার পরও তিনি খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছেন।

আজ বৃহস্পতিবার সোয়া তিনটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট মোড়ে কথা হয় নিলুফা আক্তারের (৩০) সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, তিন মাসের বাচ্চাকে ঘরে রেখে এসেছেন তিনি। স্বামী গাড়ির (প্রাইভেট কার) চালক। সে আয় দিয়েই চার মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রীর সংসার।

আজ চট্টগ্রামের ২১ থেকে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এর মধ্যে দেওয়ানহাট মোড়ে বেলা ১১টায় শুরু হয় পণ্য বিক্রি। বেলা তিনটার দিকে ৩৫০ ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি শেষ হয়। এ জন্য পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন নিলুফা আক্তারসহ অন্তত ৩০ জন।

পণ্য না পাওয়া ব্যক্তিদের আরেকজন মাঝবয়সী গৃহিণী রেহানা আক্তার। তিনি বলেন, পণ্য বিক্রির খবর তিনি জানতেন না। স্থানীয় লোকজনকে নিতে দেখে তিনি ছুটে এসেছেন। দিনমজুর স্বামীর স্বল্প আয় থেকে জমিয়ে তিনি পণ্য নিতে এসেছিলেন। নিলুফা ও রেহানা একই সঙ্গে সারিতে ছিলেন। ধাক্কায় দুজনই ছিটকে পড়েন। শেষে আর পণ্য পাননি।

দেওয়ানহাট এলাকাটি নগরের উত্তর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের আওতাধীন। এই ওয়ার্ডের জনসংখ্যা বিবিএসের হিসাবে ৩৫ হাজার ৪২১ জন। ওয়ার্ডে একটি ট্রাকে বরাদ্দ পণ্য ৩৫০ জনের জন্য। সেই হিসেবে দিনে প্রতি ১০০ জনে ১ জন ভোক্তা পণ্য পাবেন।

ভিড়, হট্টগোল, অপেক্ষা

দেওয়ানহাট মোড়ে বেলা বাড়ার সঙ্গে ভিড় বাড়তে থাকে। পণ্য কেনার সারির পাশে কথা হয় সদ্য চাকরি হারানো মোহাম্মদ সবুজের সঙ্গে। আড়াই বছরের শিশুসন্তান কোলে নারীদের সারির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। জানালেন, স্ত্রী পণ্য কেনার সারিতে, তাই অপেক্ষা করছেন তিনি।

বেলা ১২টার দিকে সরেজমিনে দেওয়ানহাট মোড়ে দেখা যায়, পণ্য কেনার দুই সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন অন্তত ৩০০ মানুষ। পুরুষ ও নারীর পৃথক দুটি সারিতে সমান ভিড়। তাঁদের কেউ কেউ সন্তান কোলে আবার কেউ সন্তানকে একা ঘরে রেখে পণ্যের আশায় দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। এর আগে অনেকে পণ্য নিয়ে চলে গেছেন।

বেলা আড়াইটার দিকে ট্রাকে ১৮ জনের পণ্য মজুত ছিল। তবে পণ্যের অপেক্ষায় ছিলেন ৫০ জনের বেশি। তাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পণ্য কিনতে পারবেন না জেনে এ সময় হট্টগোল শুরু করেন তাঁরা। একপর্যায়ে ট্রাকের পাশে এসে অনুনয়-বিনয় শুরু করেন। তবে পণ্য না পেয়ে তাঁদের খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। অনেকেই ট্রাক আবার কবে আসবে সে তথ্য নিতে ডিলারের (পরিবেশক) কাছে ছুটে যান।

নগরে বর্তমানে সপ্তাহে ৬ দিন ৬০টি স্থানে (প্রতিদিন ২০টি) ট্রাকে করে প্রতিদিন ৭ হাজার ভোক্তার কাছে চাল, ডাল ও তেল বিক্রি করছে টিসিবি। পাশাপাশি নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে প্রতি মাসে পরিবার কার্ডের মাধ্যমে নগরের ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫০ জন ভোক্তার কাছে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। দেওয়ানহাট এলাকার টিসিবির পরিবেশক জানে আলম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি যাতে কেউ খালি হাতে না ফেরে। তবে বরাদ্দ কেবল ৩৫০ জনের জন্য। যারা পাননি তাঁদের আগামী সোমবার আসার জন্য বলেছি।’

পরিবার কার্ড হালনাগাদের আহ্বান

চট্টগ্রাম নগরের জনসংখ্যা নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সিটি করপোরেশনের হিসাবে, নগরের বাসিন্দা ৬০ লাখের বেশি। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে তা ৩২ লাখ ৩০ হাজার ২৬২ জন। সেই হিসাবে টিসিবির পরিবার কার্ডের মাধ্যমে মাসিক কার্যক্রমের আওতায় পণ্য বরাদ্দ জনসংখ্যার তুলনায় কেবল ১০ শতাংশ মানুষের জন্য। ভোক্তারা বলছেন, নগরে বরাদ্দ অন্তত ৫ লাখ মানুষের জন্য হলেও আরও অনেক ভোক্তা পণ্য কিনতে পারতেন।

ট্রাক সেলের মাধ্যমে নতুন করে প্রতিদিন আরও সাত হাজার মানুষকে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। সেই হিসাবে গড়ে ২৬ দিনে ১ লাখ ৮২ হাজার ভোক্তা পণ্য পাবেন। তবে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবার কার্ড লাগছে না। ট্রাকে পণ্য পরিবেশকেরা বলছেন, অনেকেই দুইবার করেও পণ্য কিনছেন। এতে অন্য ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তবে বর্তমান আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে কাউকে বাধা দিচ্ছেন না তাঁরা। ট্রাক সেল কমিয়ে দোকানে পরিবার কার্ড হালনাগাদের কথা জানান তাঁরা।

টিসিবি ডিলার কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি মো. আবদুস ছবুর বলেন, ‘ট্রাক সেলে প্রায়ই একই ভোক্তারা পণ্য কিনছেন। অপেক্ষা করে পণ্য কেনেন, তাই আমরা বাধা দিই না। তবে ট্রাক সেল না বাড়িয়ে দোকানে পরিবার কার্ডগুলো হালনাগাদ করলে বেশি ভোক্তা পণ্য পাবেন।’

টিসিবি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবার কার্ডের তথ্য ইতিমধ্যে হালনাগাদ করা হচ্ছে। নতুন স্মার্ট পরিবার কার্ড আসার পর সে অনুযায়ী পণ্য বিক্রি হবে। ট্রাক সেল ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে।