ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলার পাঁচটি উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এ কারণে তাঁরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। তিনটি পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় প্লাবিত ৩৭টি বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ আছে।
আজ শুক্রবার সকাল নয়টায় কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৭৮ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৭২ সেন্টিমিটার ও হাতিয়া পয়েন্টে ৮০ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদ ও ধরলা নদীর পানি বাড়লেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম সদর পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদের পানি বাড়লেও পাটেশ্বরী পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চরের বাসিন্দা আজিজুল হোসেন বলেন, তিন দিন ধরে ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়ে তাঁর ঘরে উঠেছে। ছেলে-মেয়ে ও পরিবার নিয়ে গত রাতে নৌকায় ছিলেন। শেষ রাতে গোয়ালঘরে পানি উঠেছে। এখন গবাদিপশু পানিতে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। খুব বিপদের মধ্যে আছেন।
বন্যা-পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে কুড়িগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলে হালকা থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ফলে আগামী তিন দিন ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এ সময় কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এ ছাড়া তিস্তা, ধরলা নদী ও দুধকুমার নদের পানি আগামী তিন দিন বেড়ে স্বল্প মেয়াদে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। জেলার নদ-নদীর অববাহিকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে মধ্যম মানের বন্যা হতে পারে।
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বাড়ায় অনেক স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আজ সকালে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দীন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, জেলার ১৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ৩৭টি বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে। তিস্তা নদীর ভাঙনে চর গুজিমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিলীন হয়েছে। ১ নম্বর খামার দামার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একাংশ ভেঙে গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বন্যাকবলিত বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বেড়ে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নে ৫ হাজার, যাত্রাপুর ইউনিয়নে ৩০ হাজার, চিলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নে ১২ হাজার, নয়ারহাট ইউনিয়নে ১৬ হাজার, অষ্টমীর চর ইউনিয়নে ২২ হাজার, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নে ১২ হাজার, বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ২০ হাজার, নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নে ২৪ হাজার, বল্লভের খাস ইউনিয়নে ২ হাজার, বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে ৬ হাজার, নুনখাওয়া ইউনিয়নে ১২ হাজার, রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নে ২২ হাজার, মোহনগঞ্জ ইউনিয়নে ৮ হাজার, কচাকাটা ইউনিয়নে ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। জেলার পাঁচটি উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে প্রায় ২ লাখ ১ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
তবে আজ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পাওয়া তথ্যমতে, জেলার ৬২ হাজার ২০০ জন পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্যার্তদের জন্য নগদ অর্থ ও ত্রাণ পর্যাপ্ত রয়েছে। জেলায় মোট ৪০০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পানির তীব্র স্রোতে কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর, উত্তর কোদালকাটি, চর সাজাই, তেরো রশি, হাজিপাড়ায় শতাধিক পরিবার তাদের বসতি হারিয়েছে। নদীভাঙা পরিবার ও বন্যার্তদের জন্য মাত্র তিন মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, চারদিকে বন্যার্ত মানুষের আহাজারি। বন্যার্ত মানুষের জন্য সরকারিভাবে যে বরাদ্দ আসে, সেটি এক-দুটি চরের জন্যও যথেষ্ট নয়। এত কম ত্রাণ নিয়ে কোথায় যাবেন? কোন চর বাদ রেখে কোন চরে ত্রাণ দেবেন?