মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটের ১২টি চা-বাগানের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ধাপে ধাপে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি)। প্রথম ধাপের টাকা আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ অবস্থায় কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন চা-শ্রমিকেরা।
তিন মাস ধরে এনটিসির ১২টি চা-বাগানের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন না। এই শ্রমিকেরা চা-বাগানের কাজের ওপরই নির্ভরশীল। মজুরি না পাওয়ায় শ্রমিকেরা অমানবিক দুর্দশার মধ্যে পড়েন। অনেকের পক্ষে প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক শ্রমিক চা-বাগানের বাইরে কম পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। সবার পক্ষে প্রতিদিন কাজ জোটানোও সম্ভব হচ্ছে না।
এনটিসি ও চা-শ্রমিক নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, অচলাবস্থা কাটাতে গতকাল রোববার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সভাকক্ষে এনটিসির সঙ্গে চা-শ্রমিক ও কর্মচারীদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে শ্রমিকদের ছয় সপ্তাহের বকেয়া মজুরির মধ্যে দুই সপ্তাহের মজুরি এবং মাসিক বেতনধারী শ্রমিকদের এক মাসের বেতন পরিশোধ করা হবে। অবশিষ্ট চার সপ্তাহের মজুরি আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া চলতি ডিসেম্বর মাস থেকে প্রতি সপ্তাহের মজুরি নিয়মিতভাবে দেওয়ার সিদ্ধান্তও কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জানিয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার থেকে কাজে ফেরার ঘোষণা দেন চা-শ্রমিকেরা।
বৈঠকে এনটিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদ হাসান, মহাব্যবস্থাপক এমদাদুল হক, শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সৈয়দ মাহামুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তহবিলের অভাবে এত দিন মজুরি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সরকারের হস্তক্ষেপে অচলাবস্থার নিরসন হচ্ছে। চা-শ্রমিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠকে ধাপে ধাপে বকেয়া মজুরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর শ্রমিকেরা কাজে ফেরার ঘোষণা দেন।
এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করছি চা-বাগান চালু হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রমিকদের টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। সভায় কথা হয়েছে, টাকা পাওয়ার পরের দিন শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেবেন।’
চা-শ্রমিক, শ্রমিকনেতা ও বাগান কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট চায়ের ৭ শতাংশ উৎপাদিত হয় এনটিসির এই ১২টি বাগানে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এনটিসির পরিচালনা বোর্ড ভেঙে পড়ে। এনটিসির বাগানগুলোতে কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে শ্রমিকদের মজুরির অর্থ আসে। সরকার পরিবর্তনের পর এই অর্থ আসা বন্ধ হয়ে যায়। চা-বাগান কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরি দিতে পারেনি। এ সময় ছয় সপ্তাহ মজুরি ছাড়াই কাজ করেছেন শ্রমিকেরা। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সংসার অচল হয়ে পড়ায় ২১ অক্টোবর থেকে শ্রমিকেরা কাজ বন্ধ করে দেন। তৈরি হয় অচলাবস্থা। চা–শ্রমিকদের জীবন চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে। বকেয়া মজুরি ও কাজের দাবিতে চা-শ্রমিকেরা সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এ অচলাবস্থা কাটাতেই বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের মধ্যস্থতায় বৈঠকটি হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে চা-বাগানের স্টাফদের এক মাসের বেতন ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। মজুরি পরিশোধ সাপেক্ষে পরবর্তী কর্মদিবসে শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করবেন। চা-বাগানগুলোর স্বাভাবিক কাজ অব্যাহত থাকবে এবং শ্রমিকদের মজুরি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হবে।
একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যে ছয় সপ্তাহ শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করতে পারেননি, সে সময়কার মজুরির দাবি কোম্পানির বোর্ডে উপস্থাপন করা হবে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত পাওয়া সাপেক্ষে সে বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বাংলাদেশ চা-সংসদের (বিসিএস) সার্কুলার ও গেজেট অনুযায়ী ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যোগ করে ১৭৮ টাকা ৫০ পয়সা হারে দেওয়া হবে।
এনটিসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাগান বন্ধের দিনগুলোতে প্রদত্ত রেশন মানবিক কারণে কর্তন করা হবে না। এ ছাড়া বোনাস ও বার্ষিক ছুটির দিন গণনার ক্ষেত্রে বাগান বন্ধের দিনগুলোকে অনুপস্থিত দেখানো হবে না। শ্রমিক ও কর্মচারীদের বকেয়া ভবিষ্য তহবিলে (পিএফ) অর্থ আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে পরিশোধের সিদ্ধান্তও বৈঠকে নেওয়া হয়।
চা-শ্রমিক নেতারা জানান, ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বুধবারের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হবে। এটা হলে বৃহস্পতিবারের মধ্যেই শ্রমিকেরা কাজে ফিরবেন। আর যদি বৃহস্পতিবার বেতন দেওয়া হয়, তবে পরদিন শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় এর পরের দিন শনিবার থেকে কাজে ফিরবেন শ্রমিকেরা।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা প্রথম আলোকে বলেন, বকেয়া মজুরির প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়ার পরই চা-শ্রমিক ও কর্মচারীরা কাজে ফিরবেন।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমিকেরা কাজ করতে চান। বাগান খোলার সিদ্ধান্তে শ্রমিকেরা খুশি। শ্রমিকদের প্রত্যাশা—সিদ্ধান্তগুলো যথাযথভাবে প্রতিপালিত হবে।’ এই শ্রমিকনেতা আরও বলেন, ‘শ্রমিকেরা কাজে যাননি এটা ঠিক; কিন্তু তাঁরা তো ধর্মঘট করেননি। ৬টা পেমেন্ট (সাপ্তাহিক মজুরি) হয়নি। তখন তাঁরা বিকল্প কাজের খোঁজে বেরিয়ে গেছেন। এতে এমনিতেই চা-বাগানে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। মালিকপক্ষকে আমরা এই বাস্তবতা বোঝাতে পেরেছি।’ তিনি বলেন, বৈঠকে অংশ নেওয়া সবার মতামতেই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে।