ছেলে হৃদয় ইসলামের ছবি হাতে মা সাজেদা বেগম
ছেলে হৃদয় ইসলামের ছবি হাতে মা সাজেদা বেগম

ঘুম ভেঙে হৃদয় গিয়েছিল আন্দোলন দেখতে, এক ঘণ্টার মধ্যে ফেরে লাশ হয়ে

বাবা অসুস্থ হওয়ায় সংসারের হাল ধরার জন্য পিকআপ ভ্যানে সহকারীর কাজ করত হৃদয় ইসলাম (১৪)। বাসার বাইরে আন্দোলন চলছিল। ঘুম ভেঙে তা দেখতে বের হয়েছিল সে। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিরঘুমে চলে যায় হৃদয়। গত ২০ জুলাই গাজীপুরের গাছা এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে এই কিশোর নিহত হয়।

হৃদয় ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার সাখুয়া ইউনিয়নের গন্ডখোলা গ্রামের মো. সুলতান (৫০) ও সাজেদা বেগম (৪২) দম্পতির ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট ছিল হৃদয়। তার বড় ভাইয়ের নাম গোলাপ মিয়া (২৬)। তিনি গাজীপুরের গাছা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।

স্বজনেরা বলেন, গাজীপুরের গাছা এলাকায় প্রায় ২৫ বছর আগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস শুরু করেন সুলতান। গাছা বড়বাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন সুলতান। অসুখে অচল হয়ে পড়েন তিনি। সেই থেকে আর কাজ করতে পারেন না। বড় ছেলে পোশাক কারখানায় কাজ নিলেও একজনের আয়ে সংসার চলছিল না। পরে হৃদয় সংসারের হাল ধরতে পিকআপ ভ্যানের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। এভাবে দুই ছেলের আয়ে চলছিল সংসার।

গত ২০ জুলাই গ্রামের বাড়ি ত্রিশাল থেকে সকালে গাছা বড়বাড়ি এলাকার তাদের ভাড়া বাসায় যায় হৃদয়। দিনভর ঘুমিয়ে বিকেল পাঁচটার দিকে আন্দোলন দেখতে বন্ধুদের সঙ্গে বের হয়। বাসার কাছেই বিকেল ছয়টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় হৃদয়। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে বাসার সামনে নিয়ে আসে বন্ধুরা। ‘হৃদয় গুলি খেয়েছে’ বলে বন্ধুরা চিৎকার করতে থাকে। পরে সেখান থেকে পরিবারের লোকজন স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে হৃদয়ের বড় ভাই গোলাপ মিয়া বলেন, গুলি শুরু হয়েছে দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল হৃদয়। কিন্তু পিঠ দিয়ে একটি গুলি লেগে বুক চিরে বেরিয়ে যায়। লাশ গ্রামের বাড়িতে নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। পরে বড়বাড়ি এলাকায় যে বাসায় তাঁরা ভাড়া থাকেন, সে বাসার মালিকের পারিবারিক কবরস্থানে ২০ জুলাই রাতেই দাফন করা হয়। ময়নাতদন্তও করা হয়নি।

হৃদয়কে হারিয়ে গাছা থেকে ত্রিশালের গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছেন মা–বাবা। বাবা মো. সুলতান বলেন, ‘পোলাপানের ভবিষ্যতের লাইগ্যা বাড়ি ছাড়ছিলাম। এক পোলা গুলি খাইয়্যা মরল, আরেক পোলার যদি কিছু হয়ে যায়, তার লাইগ্যা বাড়িত আয়া পড়ছি। হেইন থাইক্যা কী করমু।’ তিনি আরও বলেন, ‘পোলারে কারা গুলি করছে কইতে পারমু না, পুলিশের করল না অন্য কেউ করল। মামলা করি নাই, করব না। বিচার চাইলেও কার নামে মামলাডা করমু, আমি চিনি না জানি না। পাবলিকে মারলে মামলা করতাম। অহন দেখছি না কে মারল, মামলা করলে কী লাভ।’

হৃদয়ে মৃত্যুতে মা সাজেদা বেগম পাগলপ্রায়। তিনি বলেন, ‘ঘুম থাইক্যা উইট্টা আমার আমার পোলা গেল বাইরে। বাড়ির আইলো গুলি খাইয়্যা। আমার ছেড়া তো কোনো আন্দোলন করতে গেছিন না। কের লাইগ্যা আমার পোলারে গুলি কইর‌্যা মারল। আমি বিচার চাই।’