মুন্সিগঞ্জে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামকে উপেক্ষা করে হিমাগার পর্যায়ে ৩০ টাকা ও খুচরা বাজারে ৩৭ টাকা করে আলুর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। হিমাগার কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন নতুন করে এ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ভুল বলছেন।
আজ বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার তিনটি হিমাগার ঘুরে ব্যবসায়ী ও হিমাগার ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে আলুর দামের এ তথ্য জানা গেছে।
খুচরা বাজারে আলুর দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় গত বৃহস্পতিবার সরকার আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা এবং হিমাগার পর্যায়ে ২৬ থেকে ২৭ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তবে ব্যবসায়ীরা এ দাম না মেনে হিমাগার পর্যায়ে ৩৯ থেকে ৪০ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৪৫-৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার মুন্সিগঞ্জের হিমাগারে পরিদর্শনে আসেন জাতীয় ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। হিমাগার পরিদর্শন শেষে রোববার থেকে পাকা রসিদের মাধ্যমে ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে পাইকারি এবং খুচরা বাজারে ৩৫-৩৬ টাকা বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে।
ভোক্তার অধিকারের মহাপরিচালকের নির্দেশনার পর প্রায় পাঁচ দিন হিমাগারে আলু বিক্রি বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা। এতে আলুর সংকট দেখা দেয় খুচরা বাজারে। তবে কয়েকটি হিমাগার থেকে এ কয়েক দিন স্বল্প আকারে আলু বের করেন ব্যবসায়ীরা। সে আলুর দাম নির্ধারণ না করেই বরিশাল ও চট্টগ্রামের আড়তে পাঠান ব্যবসায়ীরা।
আজ বুধবার সকাল ১০টার দিকে হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম, আলু বের হওয়ার বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে যান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। মুক্তারপুর এলাকার বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে দেখা যায়, হিমাগার থেকে আলু বের করে ছাউনির মধ্যে রাখা হয়েছে। সেগুলো বাছাই করছেন শ্রমিকেরা। পাঁচ দিন হিমাগারটি স্থবির থাকলেও আজকে ছিল কর্মচাঞ্চল্যপূর্ণ।
এ সময় হিমাগারের শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীরা জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে তাঁদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের সভা হয়েছে। সেখানে আলুর ক্রয়-বিক্রয়মূল্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একপর্যায়ে হিমাগার থেকে ৩০ টাকা দরে আলু বিক্রি করার অনুমতি দেন জেলা প্রশাসক। তবে খুচরা বাজারে ৩৭ টাকা মধ্যে রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপন আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা বলছেন ৩০ টাকার কথা, তাঁরা ভুল বলছেন। সভায় আমরা বলেছি খুচরা পর্যায়ে ৩৬ থেকে ৩৭ টাকায় বিক্রি করতে। হিমাগার পর্যায়ে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি করা হবে।’
আজ দুপুরে মুক্তারপুরের বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজের একটি খুঁটিতে কাগজে লাল কালির অক্ষরেও বড় করে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আলুর মূল্য নির্ধারণ। প্রতি কেজি আলুর দাম ৩০ টাকা।’ ৩০ টাকা দরে আলু বিক্রির খবরে হিমাগার থেকে ১৫০ বস্তা আলু বের করে শেডে রাখেন মজুতদার ব্যবসায়ী মো. ইউনুস ব্যাপারী। তিনি বলেন, ‘দুই হাজার বস্তা আলু কিনেছিলাম ৩৬ টাকা করে। এখনো এক হাজার বস্তা আলু আছে। আলুর দাম ২৬-২৭ টাকা নির্ধারণ করার পর আলু বিক্রি করিনি। গতকাল ডিসি সাহেবের অনুমতি নিয়ে আবারও ৩০ টাকা কেজি আলু বিক্রি শুরু করেছি।’
আজ দুপুর ১২টার দিকে রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও একটি ছাউনিতে আলু ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। হিমাগারের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম বলেন, আজকে আরও সাড়ে পাঁচ শ বস্তা আলু হিমাগার থেকে বের হবে। দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমাদের কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।’
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কদম রসুল কোল্ড স্টোরেজে ঢুকতেই আলুর দামের একটি ব্যানার চোখে পড়ে। সেখানেও ৩০ টাকা দাম লেখা ছিল। হিমাগারটির ব্যবস্থাপক প্রশান্ত কুমার মণ্ডল বলেন, ‘ইউএনও অফিস থেকে তাঁর সিএ আমাকে ফোন করে হিমাগার পর্যায়ে ৩০ টাকা করে ব্যবসায়ীদের আলু বিক্রি করতে বলেছিলেন। আমি তাদের বলেছি সরকার বেঁধে দেওয়া ২৬-২৭ টাকা দামের ব্যাপারে যেভাবে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল, ৩০ টাকার বিষয়টি সেভাবে চিঠি দিয়ে জানালে ব্যবস্থা নেব। আমরা ব্যানারে ৩০ টাকা লিখেছি, আজকের মধ্যে চিঠি দিয়ে না জানালে ৩০ টাকা মুছে ফেলব।’
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও হিমাগারমালিকেরা সভা করেন। সেখানে তাঁরা দাবি জানিয়েছিলেন, ৩০ টাকা করে আলু বিক্রি করলে তাঁদের লোকসান হবে না। তিনি সভায় ছিলেন না। ৩০ টাকার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলতে পারবেন বলে জানান ইউএনও।
জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপন বলেন, যাঁরা ৩০ টাকা বলেছেন, ব্যানারে লিখেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ‘ইতিমধ্যে সরকার নির্ধারিত দামে হিমাগার থেকে আলু বের হওয়া শুরু করেছে। আমি নিজে হিমাগার ঘুরে তদারকি করছি।’
তবে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে গতকালের সভায় উপস্থিত থাকা একজন হিমাগার ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীদের আবদারের পরিপ্রেক্ষিতে হিমাগারে ৩০ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে ৩৭ টাকা থেকে ৪০ টাকার মধ্যে রাখার পক্ষে ছিলেন প্রশাসনের লোকজন। বিষয়টি লিখিত নয়, গোপন রাখার কথা ছিল।