কুড়মালি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে উজ্জ্বল মাহাতোর চেষ্টা

উজ্জ্বল মাহাতো
ছবি: সংগৃহীত

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ‘মাহাতো’ পরিবারে উজ্জ্বলের জন্ম। পুরো নাম উজ্জ্বল মাহাতো। পেশায় তিনি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের স্পেয়ার মেকানিক। চাকরি করেই উজ্জ্বল দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। তবে তিনি শিকড় থেকে দূরে যেতে পারেননি। ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা মাহাতো জনগোষ্ঠীর ভাষা ‘কুড়মালি’ উজ্জ্বলের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। অন্য দশটা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ভাষার মতো কুড়মালিও হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই নিজের ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে চাকরির পাশাপাশি কুড়মালি ভাষায় গান, উপন্যাস আর অনুবাদ রচনা করে যাচ্ছেন উজ্জ্বল মাহাতো।

উজ্জ্বলের বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম আটঘড়িয়া গ্রামে। দুই ভাই আর চার বোনের মধ্যে উজ্জ্বল সবার বড়। উজ্জ্বলের স্ত্রী পার্বতী রানি মাহাতো স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হয় উজ্জ্বলের। পরে পশ্চিম আটঘড়িয়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে চলে যান সিরাজগঞ্জ জেলা শহরে। সেখান থেকেই এসএসসি ও এইসএসসি পাস করেন। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন উজ্জ্বল।

গত শনিবার উজ্জ্বলের সঙ্গে আলাপ হয়। কথায় কথায় জানা গেল চাকরির পাশাপাশি কুড়মালি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন তিনি। কুড়মালি ভাষা নিয়ে গবেষণার সঙ্গেও জড়িত তিনি।

উজ্জ্বল জানালেন, তাঁর বাবা দিলীপ কুমার মাহাতো আজীবন নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। বাবাকে দেখেই মূলত তিনি নিজেদের ভাষা–সংস্কৃতি রক্ষায় কাজ করার জন্য আগ্রহী হয়েছেন। সেই ভাবনা থেকে ২০১৩ সালে কুড়মালি ভাষায় তিনি ‘কারাম’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। উপন্যাসটি মাহাতো সম্প্রদায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ওই উপন্যাসে মাহাতো সম্প্রদায়ের এক যুগলের প্রেমকাহিনির মধ্য দিয়ে উঠে আসে ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের ধরনের গল্প।

কুড়মালি ভাষায় উজ্জ্বল গানও লিখেছেন। ২০১৪ সালে উজ্জ্বল মাহাতোর কথা এবং সুরে কুড়মালি ভাষায় ১২টি গান নিয়ে ‘এগঅবার’ নামে একটি অ্যালবাম বের হয়। ওই অ্যালবামের সব কটি গান গেয়েছেন দেবাশীষ মাহাতো।

উজ্জ্বল মাহাতোর লেখা উপন্যাস ‘কারাম’ ও ‘কঁআথুয়েনঁ: মাহাতো ডিকশনারি’

২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলায় তাঁর একটি গবেষণধর্মী গ্রন্থ ‘কঁআথুয়েনঁ: মাহাতো ডিকশনারি’ প্রকাশিত হয়। বইটি তিন ভাষায় (কুড়মালি, বাংলা, ইংরেজি) বাজারে আসে। বইটি মূলত কুড়মালি ভাষার একটি শব্দকোষ। এই ভাষার বিভিন্ন প্রচলিত ও অপ্রচলিত শব্দ, বাক্য, ছড়া, গীত, জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ের রীতিনীতিসহ নানা বিষয় সংকলন করা হয়েছে। এ ছাড়া বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং জাতীয় সংগীত কুড়মালি ভাষায় অনুবাদ রয়েছে।

২০২১ সালের বইমেলায় যশোর এমএম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গবেষক খ ম রেজাউল করিম, সুধাংশু শেখর মাহাতো এবং উজ্জ্বল মাহাতোর মিলিত প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে ‘মাহাতো জনগোষ্ঠী; সমাজ-সংস্কৃতি’ নামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। বইটিতে বাংলাদেশের ১৮টি জেলার ৩২টি উপজেলার মাহাতোদের জীবনযাপন, অবস্থান, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাহাতোদের ভূমিকা, শিক্ষা, সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

চলতি বছর উজ্জ্বল মাহাতোর শিশুদের জন্যও একটি বই লিখেছেন। উজ্জ্বল বলেন, ‘শিশুদের কুড়মালি ভাষা শিক্ষার লক্ষ্যে বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। বইটির শুরুতেই রয়েছে আমাদের জাতীয় সংগীত এবং কুড়মালি ভাষায় এর অনুবাদ। এই বইয়ে কুড়মালি ভাষার বর্ণমালার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস–সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় স্থান পেয়েছে। সব কটি বিষয়ের বর্ণনায় রঙিন ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ছবির মাধ্যমে শিশুরা খুব সহজেই এসব বিষয়ে জানতে পারবে।’

লেখালেখি আর সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন উজ্জ্বল। স্থানীয় তরুণদের সংগঠন মাহাতো স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এই সংগঠনের মাধ্যমে মাহাতো সম্প্রদায়ের মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। এদিকে উজ্জ্বল প্রথম আলো রায়গঞ্জ বন্ধুসভার নিয়মিত সদস্য। বর্তমানে তিনি রায়গঞ্জ বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

সদা হাস্যোজ্জ্বল এই যুবক কুড়মালি ভাষা আর মাহাতো সম্প্রদায়কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। তিনি জানালেন, শত ব্যস্ততা থাকলেও তিনি কুড়মালি ভাষায় সাহিত্যচর্চা চালিয়ে নিতে চান। আর মাহাতো সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চান বিশ্বমঞ্চে। যেন মাহাতো সম্প্রদায়ের সদস্যরা বুক ফুলিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে পারেন।