একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ২৬ মার্চ বরিশাল শহরের বগুড়া সড়কে বর্তমান সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম স্বাধীন বাংলা সচিবালয়। এখান থেকেই পরিচালিত হয় এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। এই সচিবালয়ের আদেশ-নির্দেশগুলো প্রিন্ট করা হতো তৎকালীন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একমাত্র সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রটি দিয়ে।
ঐতিহাসিক নিদর্শন সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রটি ১৫ বছর ধরে সংরক্ষণ করছে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি। প্রতিবছর বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে এটি প্রদর্শন করা হয় নতুন প্রজন্মের জন্য। এবারও মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার নগরের সদর রোডের বিবির পুকুরের পূর্ব পাড়ে রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ের মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের প্রদর্শনীতে যন্ত্রটি প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়। এটি দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন তরুণ–যুবকেরা। তাঁরা যন্ত্রটিতে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন, আবেগে আপ্লুত হয়েছেন।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থী নাইম ইসলাম গতকাল দুপুরে এসেছিলেন রিপোর্টার্স ইউনিটেতে। নাঈম বলেন, ‘অনেক দিন ধরে যন্ত্রটির (সাইক্লোস্টাইল) কথা শুনে আসছি। দেখার কৌতূহল ছিল। হাত দিয়ে ছুঁয়ে এক অজানা অনুভূতি পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর পরে আমাদের জন্ম। তাই সব সময় একটা আকুতি থাকে, এই যুদ্ধের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর দেখার জন্য। এতে একটা অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে।’
এবার প্রদর্শনীতে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় কুচকাওয়াজ করা ডামি বন্দুক, বরিশালে পাকিস্তানি সেনাদের নিক্ষেপ করা শেল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনার রেডিও, প্রথম সংবিধানের কপি, প্রথম মানচিত্র, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কপি, আলোকচিত্র, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য তৈরি করা মানচিত্র ও বইপত্র।
একাত্তরে তৎকালীন বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আজিজুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়ে সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রটি সচিবালয়ে দেন। তিনিও সচিবালয়ের কাজে যোগ দেন। এমনকি নিজের ব্যবহৃত গাড়িটিও তিনি সচিবালয়ের কাজে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। পরে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। কাজী আজিজুল ইসলামকে স্বাধীনতা পদকে সম্মানিত করা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলার প্রথম সচিবালয়ের মাধ্যমে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধকে একটি সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ দেওয়ার সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। বরিশালের সব বাঙালি সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ বিভাগ এই সচিবালয়ে এসে তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন।
সাইক্লোস্টাইল মেশিনটি ব্যবহার করতেন তৎকালীন জেলা প্রশাসনের কর্মচারী সুচিত্র কুমার দাস। তিনি জানান, তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সাইক্লোস্টাইল বসানো হয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলে স্বাধীন বাংলা সরকারের বিভিন্ন আদেশ, মুক্তিযোদ্ধা ও সরকারি দপ্তরে দেওয়ার জন্য সাইক্লোস্টাইল মেশিনটি ব্যবহৃত হতো।
বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সুশান্ত ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে যন্ত্রটি নিয়ে আমরা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ১৫ বছর ধরে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও দলিলপত্র প্রদর্শনী করে আসছে। এতে সাইক্লোস্টাইল যন্ত্রটিও প্রদর্শিত হয়। নতুন প্রজন্ম এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধের অজানা ইতিহাস।’