‘ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা রাত পৌনে ১০টার দিকে এসে বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেন। এরপর প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে অনেকগুলো ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। ঘরে ঢুকে সবাই প্রচণ্ড মারধর করেন। বিভিন্ন কক্ষে লুটপাট চালানোর একপর্যায়ে তাঁরা বইখাতা ও আসবাবে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যান। পরে প্রতিবেশীরা এসে আগুন নেভান।’
মুঠোফোনে কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মাসুদুর রহমান। গতকাল শনিবার রাতে রূপগঞ্জে ছাত্রদলের মশাল মিছিলকে কেন্দ্র করে তাঁর বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, ককটেল বিস্ফোরণ ও আগুন দেওয়ার ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, হামলার বিষয়টি তিনি জানেন না। তাঁর বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের লোকজন এমনটা করতে পারে না।
হামলার সময় পুলিশ ছাত্রদল নেতার বাড়ির বাইরে অবস্থান করছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা বলেন, এসব ঘটনা তাঁকে কেউ জানায়নি। তিনি শুনেছেন, ছাত্রদলের মশাল মিছিল থেকে কয়েকটি মোটরসাইকেল পোড়ানো হয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার কৈরাবো মোড়ে ছাত্রদল নেতা মাসুদুর রহমানের বাড়ি। আজ রোববার দুপুরে জলাভূমির মাঝখানে থাকা একতলা পাকা বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বাইরে পোড়া বিছানাপত্র পড়ে আছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকেই এক নারীকে কাঁদতে দেখা যায়। তিনি মাসুদুরের ভাবি রাবেয়া খাতুন। শনিবার রাতে তাঁর ঘরে লুটপাট করা হয়েছে। বাড়ির বাইরে তুলে নিয়ে মারধর করা হয়েছে তাঁর দশম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে অনিককে।
মাটিতে বসে বিলাপ করতে করতে রাবেয়া বলেন, ‘আমি রাজনীতির কিছু বুঝি না। আমি তাগোরে কইছি আমার সন্তানডার জান ভিক্ষা দেন। তাঁরা আমার সামনে আমার পোলাডারে কোপাইছে।’ একপর্যায়ে পাশে চেয়ারে বসা অসুস্থ ছেলের হাতের জখম ও পিঠের আঘাতের চিহ্নগুলো দেখান রাবেয়া।
মাসুদুরের ছোট বোন রেহানা আক্তার (১৪) কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘ওরা ঘরে ঢুইকা আমার গলায় ছুরি ধইরা বলে, “ঘরতে বাইর হ, নইলে কানলে গলা ফালাই দিমু।” পরে আমারে মারধর করতে করতে ছাদে নিয়া যায়। সেখানে আমার মায়েরে ফালাইয়া পিডাইছে। যাওয়ার আগে আমার বইখাতা সব পুড়াইয়া দেয়।’
বাড়িতে গিয়ে মাসুদুর রহমানকে পাওয়া যায়নি। হামলায় আহত মা–বাবাকে নিয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালে আছেন তিনি। মাসুদুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাজধানীতে তাবিথ আওয়ালসহ বিএনপির নেতা–কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে রাত ৯টার দিকে ভুলতা এলাকায় মশাল মিছিল বের করেন তিনি। মিছিল শেষ করে ফেরার পর স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীরা তাঁর বাড়িঘরে হামলা চালান। প্রধান ফটকের তালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে অন্তত আটটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান হামলাকারীরা। এ সময় বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ বাবা–মা, কিশোরী বোন, কিশোর ভাতিজা ও বড় ভাইকে পিটিয়ে আহত করা হয়। হামলার পর তাঁদের কক্ষগুলোর জিনিস ও আসবাবে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হামলাকারীরা চলে যান। পরে প্রতিবেশীরা এসে আগুন নেভান।
বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পুরো বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে—অভিযোগ করে মাসুদুর রহমান বলেন, মারধরে তাঁর মায়ের হাত ও পায়ের হাড় ভেঙে গেছে, হৃদ্রোগে আক্রান্ত তাঁর বৃদ্ধ বাবা কথা বলতে পারছেন না। হামলাকারীরা বাড়িতে থাকা নগদ ৭৩ হাজার টাকা, টেলিভিশন ও তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দেড় লাখ টাকা মূল্যের সাবান লুট করে নিয়ে যান।
থানায় অভিযোগ করা হয়েছে কি না—জানতে চাইলে এই ছাত্রদল নেতা বলেন, ‘হামলার সময় বাড়ির বাইরে এক গাড়ি পুলিশ ছিল। তাঁদের উপস্থিতিতেই এসব ঘটনা ঘটেছে। চাইলে তাঁরা তখনই হামলাকারীদের প্রতিহত করতে পারত। এখন উল্টো আমিসহ আমার মা–বাবার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা হবে বলে খবর পাচ্ছি।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, হামলার সময় পুলিশের কিছুই করার ছিল না। সেখানে সর্বোচ্চ তিন থেকে চারজন পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।