শিক্ষক হিসেবে ‘অসুস্থ’ থাকলেও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তিনি পুরোপুরি ‘সুস্থ’

জেবুন্নাহার শিলা
ছবি: সংগৃহীত

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকে পদে যোগ দিয়েছিলেন এক ছাত্রলীগ নেত্রী। কিন্তু শুরু থেকে তিনি অসুস্থতার কথা বলে ছুটি কাটিয়ে চলেছেন। এমনকি গত বছরের ১০ জুলাইয়ের পর থেকে তিনি আর এক দিনও বিদ্যালয়ে আসেননি। অথচ এ সময়ে তাঁর পরপর দেওয়া দুটি তিন মাস মেয়াদি ছুটির আবেদন মঞ্জুর করেনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে তিনি সরকারি চাকরিবিধিও লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

ওই শিক্ষকের এই দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম। অথচ ছুটিতে থাকার পুরো সময়টাতে তাঁকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। এমনকি সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি নতুন করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদে পদও পেয়েছেন।

শিক্ষক হিসেবে ‘অসুস্থ’ থাকলেও রাজনীতিতে ‘সুস্থ’ ওই শিক্ষকের নাম জেবুন্নাহার শিলা। তিনি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার পশ্চিম কালিদাস পানাউল্লাহপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সরকারি শিক্ষক। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি। থাকেন ইডেনের আবাসিক হলে।

সখীপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্র জানায়, জেবুন্নাহার শিলা গত বছরের ২৪ জানুয়ারি ওই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ওই বিদ্যালয়ে মোট ছয়জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে জেবুন্নাহার একজন। প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়টির মোট শিক্ষার্থী ১২০ জন। ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেবুন্নাহার ক্লাস নিয়েছেন মাত্র ৫৪ দিন। গত বছরের ১০ জুলাইয়ের পর থেকে তিনি আর বিদ্যালয়ে আসেননি। তিনি ১০ জুলাই থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাসের চিকিৎসা ছুটির আবেদন করেন। আবার ওই ছুটি শেষ হতেই ১১ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত চিকিৎসা ছুটির আরেকটি আবেদন জমা দেন তিনি। চলতি বছর ১০ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত তিনি কোনো আবেদন ছাড়াই ছুটি কাটাচ্ছেন।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ অংশে বলা আছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, চাকরিতে অসুস্থতার কারণে ছুটিতে থাকলেও প্রতিনিয়ত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জেবুন্নাহার শিলাকে দেখা গেছে সক্রিয়। ইডেন কলেজের আবাসিক হলে থেকে মিছিল-সমাবেশে যোগ দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল সদরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনও করেছেন ওই স্কুলশিক্ষক।

জেবুন্নাহার সরকারি চাকরিতে যোগদানের সাত মাস পর গত বছরের ২৩ জুলাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্যপদ পান। এরপর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগকে গতিশীল করার লক্ষ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ ছাড়া গত ২৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সই করা এক চিঠিতে তাঁকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে টাঙ্গাইলের সংসদীয় আটটি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। নির্বাচনের পর জেবুন্নাহার সশরীর উপস্থিত হয়ে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এসবের ছবি ফেসবুকেও পোস্ট করেন।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচনে টাংগাইল-৫ আসনে সমন্বয়কের দায়িত্ব পেয়ে ৩১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে পৌঁছে কর্মীদের সঙ্গে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন জেবুন্নাহার

জেবুন্নাহার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুবই সক্রিয়। গত জুলাই থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ফেসবুকে শতাধিক পোস্ট করলেও কখনো তিনি অসুস্থ ছিলেন এমন কোনো পোস্ট দেখা যায়নি।

ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের একজন নেত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছুটির আবেদনে জেবুন্নাহার একজন অ্যাজমা রোগী লিখলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর ওই ধরনের কোনো রোগ নেই। তিনি সরকারি চাকরির কথা গোপন রেখে বিধিবহির্ভূতভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতি করছেন। ইডেনের ছাত্রত্ব না থাকলেও ওই কলেজের আবাসিক হলে থাকছেন রাজার হালে।’ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্যপদ থেকে তাঁকে বহিষ্কারের দাবি জানান ওই নেত্রী।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চাকরিজীবী কেউ সংগঠনটির কমিটিতে থাকতে পারেন না। তাহলে জেবুন্নাহার শিলা কীভাবে রয়েছেন—এমন প্রশ্নে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ বলেন, ‘শিলা ওই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানি। তা ছাড়া ইডেনে মাস্টার্স শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিষয়ে মাস্টার্স করার কথা আমরা অবগত। এর ব্যতিক্রম হয়ে থাকলে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

হাজিরা খাতা উদ্ধৃত করে পশ্চিম কালিদাস পানাউল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধীরেন চন্দ্র সরকার জানান, গত বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ৮২ কর্মদিবসের মধ্যে জেবুন্নাহার শিলা পাঠদান করেন ৫৪ দিন। বাকি ২৮ কর্মদিবসের মধ্যে ১৫ দিন অসুস্থতাজনিত ও ১৩ দিন নৈমিত্তিক ছুটি কাটান তিনি। এরপর তিনি তিন মাস করে দুইবার চিকিৎসা ছুটির আবেদন করেন। প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, ‘তাঁর ছুটির দুটি আবেদন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের সময় ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে জেবুন্নাহার শিলা। গত ২৮ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়

সখীপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রাফিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছুটির আবেদন করে দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় গত ১৬ জানুয়ারি ও ৪ ফেব্রুয়ারি ওই শিক্ষককে দুই দফায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই থেকে ওই শিক্ষকের বেতন বন্ধ রাখা রয়েছে।’

এদিকে জেবুন্নাহারের চিকিৎসা ছুটির আবেদন দুটি এখন পর্যন্ত মঞ্জুর হয়নি জানিয়ে টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করার জন্য জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়কে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। প্রতিবেদনটি হাতে পেলেই ওই শিক্ষকের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে জানতে জেবুন্নাহার শিলার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়ম মেনেই চিকিৎসা ছুটি নিয়েছি। আর স্কুলে পাঠদানে নিয়মিত নই বলে বেতন তুলছি না। শিগগির বিদ্যালয়ে যোগদান করে খুদে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস নেব।’

সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন পাটওয়ারী বলেন, দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় শিক্ষক জেবুন্নাহারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।