রাঙামাটির লংগদু উপজেলা ভাসান্ন্যা আদাম ইউনিয়নের পশ্চিম চাইল্ল্যাতলী গ্রামে গৃহবধূ ফাতেমা বেগম। তাঁর স্বামী মো. আবদুল জব্বার দিনমজুরি করেন। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা তাঁদের। তবু জীবন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙে পড়ে এই মাথার ওপর। জানতে পারেন, লংগদু উপজেলা সোনালী ব্যাংক শাখায় ফাতেমা বেগমের নামে চারটি হিসাব খুলে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭২৪ টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে।
ফাতেমা বলেন, তিনি কখনো সোনালী ব্যাংকে ঋণের জন্য যাননি। ১২ বছর আগে সরকারি অনুদানের কথা বলে তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ফটোকপি নেওয়া হয়। সে সময় অনুদানের ৭০০ টাকা দেওয়া হয়। এখন জানতে পারছেন, সেই আইডি কার্ড দিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে তাঁর নামে চারবার ঋণ নেওয়া হয়েছে।
গৃহবধূ ফাতেমা বেগমের মতো লংগদু উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির নামে এমন ঋণ নেওয়া হয়। ১২ বছর আগে নেওয়া এই ঋণ সুদে-আসলে বেড়ে কয়েক গুণ হয়েছে। জালিয়াতি করে একটি চক্র এমন ঋণ নিয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। তবে যাঁদের নামে ঋণ নেওয়া হয় তাঁরা এর কিছুই জানতেন না। ভুক্তভোগী লোকজনের বেশির ভাগই দিনমজুর, বিধবা ও জেলে। কয়েকজন ভিক্ষুকও আছেন তাঁদের মধ্যে।
লংগদু উপজেলা ভাসান্ন্যা আদাম ও বগাচতর ইউনিয়নে ৫০৬ জনের নামে এ ধরনের ঋণ নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। তবে এ বিষয়ে লংগদু সোনালী ব্যাংক কোনো তথ্য দিচ্ছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমে ঋণ জালিয়াতির সত্যতা পায় পুলিশ। লংগদু থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জয়নাল তাঁর অনুসন্ধানে জানতে পারেন, ২০১২-১৪ সালের মধ্যে ভাসান্ন্যা আদাম ও বগাচতর ইউনিয়নে অন্তত ৫০০ জনকে এ ধরনের ঋণ দেওয়া হয়। তবে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি। তদন্তে দেখা গেছে, ভুক্তভোগী প্রত্যেকের নামে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ন্যূনতম ৫০০ লোকের নামে এই পরিমাণ ঋণ নিলে টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় দেড় কোটি টাকার মতো। বর্তমানে এসব ঋণ সুদ আর আসল মিলিয়ে দ্বিগুণের বেশি হয়।
গত রোববার সকালে ঋণ জালিয়াতির প্রতিবাদে লংগদু সদরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন ভুক্তভোগী লোকজন। ভাসান্ন্যা আদাম ও বগাচতর ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের ব্যানারে এই কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে অভিযোগ করা হয়, এলাকার কিছু দালাল ও দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে তাঁদের নাম ব্যবহার করে ঋণ নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের নভেম্বর মাসে ভাসান্ন্যা আদাম ও বগাচর ইউনিয়নের বেশ কিছু বাসিন্দার কাছে সোনালী ব্যাংক থেকে নোটিশ আসা শুরু করে। এমন প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষের কাছে নোটিশ এসেছে। তখন জালিয়াতি করে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন ভুক্তভোগীরা।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন কয়েকজন ভুক্তভোগী। পরে লংগদু থানার এসআই মো. জয়নালকে এ বিষয়ে তদন্তের ভার দেওয়া হয়। তদন্তে তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার সত্যতা পান।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনআইডি ছাড়াও তাঁদের অন্য কাগজপত্র এবং সই জাল করা হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা তদন্ত না করে কীভাবে এত জনের নামে ঋণ দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।
লংগদু থানার এসআই মো. জয়নাল বলেন, ‘তদন্তে আমি অসহায় ও নিরীহ ব্যক্তিদের নামে ঋণ নেওয়া বিষয়ে সত্যতা পেয়েছি। তবে কত টাকা তাঁদের নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা ব্যাংক জানায়নি। আমার কাছে ব্যাংক কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, লংগদুর ৫০৬ জনের নামে এমন ঋণ দেওয়া হয়েছে।’
সোনালী ব্যাংকের লংগদু শাখার ব্যবস্থাপক মো. আবুল কাসেমের সঙ্গে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কথা বলা যাবে না বলে জানান।
লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা আমার কাছে এসেছেন। তৎকালীন কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা ও কিছু স্থানীয় দালালের যোগসাজশে এমন দুর্নীতি হয়েছে বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এই ঋণ মওকুফ করার কোনো সুযোগ নেই। সোনালী ব্যাংক কিছু সুদ মওকুফ করে দিতে পারে।’
লংগদু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল বারেক সরকার বলেন, যাঁদের নামে ঋণ নেওয়া হয়, তাঁদের বেশির ভাগ ভূমিহীন ও গরিব। কেউ ভিক্ষা করে খান। কেউ দিনমজুরি করেন। এ নিয়ে নিরীহ লোকজন যেন হয়রানির শিকার না হন, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখতে তিনি লংগদু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেছেন।