সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গতকাল সোমবার থেকেই মো. আবদুস সবুরের (৩৯) ছবি ও ভিডিও ঘুরছে। অটোরিকশায় পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাচ্ছেন একজন মানুষ। তাকানো যায় না, সহ্য হয় না, তবু ভাইরাল এই ছবি দেখতে হয়েছে অনেক নেট ব্যবহারকারীকে। ভাঙা টিনের ঘরের দরজার পাশে বসে ছেলের অঙ্গার হয়ে যাওয়া ওই ছবিটিই যেন বারবার এসে হানা দিচ্ছিল মা গুলচাম্পার (৬৫) মনে। সেই ছবির কথাই ভেবেই বুঝি ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে উঠছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি যা বলছিলেন, তাঁকে সরল বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘ও বাপরে, ও বাপ, কোন দোষে এমন কয়লা হয়ে গেলি রে বাপ।’
গতকাল ঘটনার কথা শোনার পর থেকেই গুলচাম্পা কেঁদে চলেছেন। এখন আর কান্নার শক্তি নেই। ভাঙা গলায় মৃদু বিলাপের ধ্বনি শোনা যায় কেবল। বিলাপের মধ্য দিয়ে ছেলের কথাই বলছিলেন বারবার। ‘এই রোজায় প্রতিদিন আমাকে সঙ্গে নিয়েই ছেলেটি ইফতার করত সে। কালও বাড়িতে ফিরে এসে ইফতার করার কথা বলেছিল। অথচ আসল না।’
গতকাল বেলা তিনটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলঘরের বরগুনি সেতু এলাকায় বালুবোঝাই একটি ট্রাকের ধাক্কা লেগে সবুরের অটোরিকশার সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তিনির দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
সাতকানিয়া উপজেলার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইছামতি আলীনগর এলাকার নিহত মো. আবদুস সবুরের বাড়ি। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পাড়া-প্রতিবেশী নারী ও শিশুরা ভিড় করছে। সবুরের অবুঝ দুই সন্তান চার বছর বয়সী ছেলে সাইফুল ইসলাম ও দেড় বছর বয়সী মেয়ে মেহেরিমা জান্নাত এখনো বুঝতেই পারছে না তাদের বাবা আর নেই। বাড়ির সামনের ছোট্ট গলিতে অন্য শিশুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তারাও দেখছিল লোকজনের আসা-যাওয়া। কিছুক্ষণ পর সাইফুল ইসলাম দাদির কোলে চড়ে বসে। তা দেখে মেহেরিমা জান্নাতও দাদির কোলে এসে বসে। তখনো দাদি গুলচাম্পা কান্না করছিলেন।
সেখানেই কথা হয় দগ্ধ হয়ে নিহত আবদুস সবুরের বড় ভাই আবদুল গফুরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় ছয় বছর আগে রুমি আক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয় আবদুস সবুরের। তাঁদের ঘরে দুই শিশুর জন্ম হয়। গতকাল দুপুরের পর যাত্রী নিয়ে চন্দনাইশের দিকে গিয়েছিল আমার ভাইটি। বেলা তিনটার দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বালুবোঝাই একটি দ্রুতগতির ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে আমার ছোট ভাইটি মারা গেছে।’
আবদুস সবুরের বৃদ্ধা মা গুলচাম্পা কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষাকালে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। ছেলেটি আমাকে বলেছিল, এই সামনের রোজার ঈদের সময় কিছু অতিরিক্ত ভাড়া টেনে টাকা জোগাড় করবে। এরপর ওই টাকা দিয়ে ঘরের চালের টিন বদলাবে। এখন ছেলেটি আগুনে পুড়ে মরে গেল। ঘরের চালের টিন কে বদলাবে। আমি কার কাছে থাকব, কে আমাকে খাওয়াবে?’
আবদুস সবুরের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে তাঁর স্ত্রী রুমি আক্তার তিন-চারবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন।
গতকাল সকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই শিশু শিশুসন্তানকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। ছোট সংসারটা অল্পতেই চলে যেত। তবে আবদুস সবুরের স্বপ্ন ছিল, ভাঙা ঘরটি নতুন করে মেরামত করবেন। আর দুই সন্তানকে শিক্ষিত করবে।
পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) স্থানীয় সদস্য আবছার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আবদুস সবুর প্রায় ১৫ বছর ধরে অটোরিকশার চালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি এলাকায় অমায়িক হিসেবে পরিচিত। তাঁর এমন নির্মম মৃত্যু এখন সবার মুখে মুখে। কেউ মানতে পারছে না।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ এরফান প্রথম আলোকে বলেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই অটোরিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। পরে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ওই চালকের পরিবারের সদস্যদের কোনো ধরনের আপত্তি বা অভিযোগ না থাকায় আইনিপ্রক্রিয়া শেষে গতকাল রাতে চালকের লাশটি পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।