মুন্সিগঞ্জ

বেপরোয়া বাল্কহেড, ঘটছে দুর্ঘটনা

তালতলা-গৌরগঞ্জ খালে বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে। সেই নিষেধ কেউ মানছেন না। প্রশাসনের নজরদারির ঘাটতির অভিযোগও রয়েছে।

মুন্সিগঞ্জে ট্রলারডুবির ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে নৌ পুলিশ। এ সময় বালুবোঝাই ২৮টি বাল্কহেড, ৩টি বালু উত্তোলনকারী খননযন্ত্র জব্দ করা হয়। গত রোববার চাঁদপুরের আলুর বাজার এলাকায়
 ছবি: প্রথম আলো

নদীভাঙন ও নৌদুর্ঘটনা বন্ধে পদ্মা এবং শাখানদীতে বাল্কহেড চলাচলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এমনকি স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতারা ‘নৌ বিক্ষোভ’ পর্যন্ত করেছেন। এরপরও কোনোভাবেই দিনে–রাতে বাল্কহেডের চলাচল বন্ধ করা যায়নি। এ কারণে প্রায়ই ঘটছে ছোট–বড় দুর্ঘটনা।

সর্বশেষ গত শনিবার রাতে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার রসকাটি এলাকায় তালতলা-গৌরগঞ্জ খালে (পদ্মার শাখানদী) বাল্কহেডের ধাক্কায় বনভোজনের একটি ট্রলার ডুবে নারী ও শিশুসহ ৯ জন মারা যান। ওই ঘটনায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত আরও একটি শিশু নিখোঁজ রয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে বাল্কহেডের ধাক্কায় ঈদুল আজহার আগে গরুভর্তি ট্রলার ডুবে যায়। গত বছর নিবন্ধনহীন একটি বাল্কহেড বেপরোয়াভাবে চালানোয় টঙ্গিবাড়ীর কুন্ডেরবাজার বেইলি সেতুর পিলারে ধাক্কা দেয়। এতে সেতুর পিলার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক মাস সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ ছিল। এসব কারণে গত বছরের বর্ষা মৌসুমে এই নৌপথ দিয়ে বালুবাহী কার্গো বা বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই আবার বাল্কহেডের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল শুরু হয়।

বাল্কহেড চলাচল বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আবুজাফর রিপন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবৈধ চলাচল বন্ধ করা হবে। তবে বাল্কহেড চলাচল শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রশাসনের পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএ, নৌ পুলিশ, থানা–পুলিশ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

গত রোববার বনভোজনের ডুবে যাওয়া ট্রলারটি উদ্ধারে কাজ করছিলেন ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ডসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল দিয়েই তিনটি বাল্কহেডকে পদ্মা নদীর দিকে যেতে দেখলেন এই প্রতিবেদক।

গত শনিবার ট্রলার দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও দুই সন্তান হারানো জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে কোনো রকম বাতি না জ্বালিয়ে চুপিসারে বাল্কহেড বালু আনতে পদ্মা নদীর দিকে যাচ্ছিল। আমাদের ট্রলারটি দূর থেকে তাদের দেখতে পায়নি। কাছাকাছি এলে আমরা তাদের টর্চ জ্বালিয়ে সংকেত দিই। এরপরও তারা আমাদের ওপরে উঠে যায়।’ আক্ষেপ করে জাহাঙ্গীর বলেন, যদি প্রশাসনের নজরদারি থাকত, রাতের বেলা বাল্কহেড চলাচল না করত, চলাচল করলেও সংকেত বাতি থাকত, তাহলে তাঁদের চালক দূর থেকে দেখতে পেতেন। এত বড় দুর্ঘটনা না–ও ঘটতে পারত।

এর আগে চলতি বছরের মে মাসে লৌহজং উপজেলায় পদ্মা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, অবৈধ বাল্কহেড চলাচলের প্রতিবাদে নৌযানে করে বিক্ষোভ করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েক শ নেতা-কর্মী। সেদিন নৌ বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশে ছিলেন মুন্সিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন। অর্ধশত ট্রলারে সহস্রাধিক নেতা-কর্মী ওই বিক্ষোভে অংশ নেন। বিক্ষোভ থেকে বালু উত্তোলন করতে আসা বাল্কহেডকে ধাওয়া করে পিছু হটিয়ে দেন তাঁরা। কিন্তু বাল্কহেডের চালকেরা এতটাই বেপরোয়া যে সেদিন বিক্ষোভ শেষ হওয়ামাত্রই আবারও পদ্মায় বালু বহনে সারি সারি বাল্কহেড নেমে পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন বলেন, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির কারণে নিষেধ অমান্য করে তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল (পদ্মার শাখানদী) দিয়ে অবাধে বাল্কহেড চলাচল করছে। উপজেলা প্রশাসন মাঝেমধ্যে দু-একটি অভিযান চালায়। তবে এসব নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড এগুলোর নিয়ন্ত্রণে নেই বললেই চলে।

এ বিষয়ে লৌহজংয়ের ইউএনও মো. আবদুল আওয়াল প্রথম আলোকে বলেন, এ খাল দিয়ে বাল্কহেড চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গত বছর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষের মাধ্যমে পাহারার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। বাল্কহেড বন্ধ রাখতে বাঁশ ও বয়া দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১২১টি বাল্কহেড ও ড্রেজারকে নিয়ম না মানায় ১ কোটি ৬৪ লাখ ৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

লোকবল কম থাকার কথা জানালেন মাওয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বড় পদ্মা নদীতে অভিযানের পর চাইলেও শাখানদীতে বেশি বিচরণ করা যায় না। যদি লোকবল বেশি থাকত, তাহলে হয়তো সবদিকেই আমরা সমানতালে নজর দিতে পারতাম। এরপরও দুর্ঘটনার পর থেকে আমরা কঠোর হয়েছি। গতকাল (রোববার) আটটি নৌযানের বিরুদ্ধে মামলা
দেওয়া হয়েছে।’