গৃহবধূর লাশ ফ্রিজে

র‌্যাব ছেলের সম্পৃক্ততার কথা বললেও পুলিশের তদন্তে এল ভিন্ন তথ্য, আদালতে একজনের জবানবন্দি

উম্মে সালমা হত্যা মামলায় দুপচাঁচিয়া থানা-পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার মাবিয়া সুলতানা, মোসলেম উদ্দিন ও সুমন রবিদাস। এর মধ্যে মোসলেম উদ্দিন আজ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় দিনদুপুরে বাসায় ঢুকে উম্মে সালমা (৫০) নামের এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখার ঘটনায় পুলিশের তদন্তে নতুন তথ্য উঠে এসেছে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে ফ্ল্যাটের একজন ভাড়াটে নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে দুপচাঁচিয়া থানা-পুলিশ। তাঁরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে উম্মে সালমার বাসায় ঢুকেছিলেন এবং পরে তাঁকে হত্যা করেন বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন। এর মধ্যে একজন আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এই হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুপচাঁচিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুব্রত কুমার সিংহ ও বগুড়ার আদালতের পরিদর্শক মোসা‌দ্দেক হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার আলামত পেয়ে গত সোমবার রাতে উম্মে সালমার ছোট ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানকে (১৯) গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে র‍্যাব-১২-এর বগুড়া ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর মো. এহতেশামুল হক খান দাবি করেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাদ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

এদিকে থানা-পুলিশের হাতে নতুন গ্রেপ্তার তিনজন হলেন উম্মে সালমার বাসার চারতলার ফ্ল্যাটের ভাড়াটে মাবিয়া সুলতানা (৪১), দুপচাঁচিয়া উপজেলার তালুচ পশ্চিম পাড়ার আবদুর রহিমের ছেলে মোসলেম উদ্দিন (৩২) এবং তালুচ বাজারের নারায়ণ রবিদাসের ছেলে সুমন রবিদাস (৩০)। তাঁদের মধ্যে মাবিয়া সুলতানার বাসা থেকে উম্মে সালমার ফ্ল্যাটের চাবি এবং মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি থেকে বাসার ইন্টারনেট সংযোগের রাউটার জব্দ করা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুব্রত কুমার সিংহ দাবি করে বলেন, গ্রেপ্তার তিনজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উম্মে সালমা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ডাকাতির উদ্দেশ্যে তাঁরা ওই বাসায় ঢুকেছিলেন। পরে উম্মে সালমাকে তাঁরা হত্যা করেন। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানের জন্য তাঁদের বগুড়া আদালতে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তার মাবিয়া সুলতানা দুপচাঁচিয়া উপজেলার ইসলামপুর উত্তর সাজাপুরের গাড়িচালক আইয়ুব আলীর স্ত্রী। সাত মাস আগে উম্মে সালমার চারতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন তিনি।

বগুড়ার আদালতের পরিদর্শক মোসা‌দ্দেক হোসেন বলেন, গৃহবধূ উম্মে সালমা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আসামি মোসলেম উদ্দিন আজ সন্ধ্যায় বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

আদালতসংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি মোসলেম উদ্দিন বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডে তিনি নিজে, উম্মে সালমার বাসার চারতলার ভাড়াটে মাবিয়া সুলতানা ও সুমন রবিদাস জড়িত। মোসলেম আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আরও উল্লেখ করেন, ওই বাসার চারতলায় মাবিয়া সুলতানা ভাড়া থাকতেন। তাঁর বাসায় নানা ধরনের লোকের যাতায়াত ছিল। এ নিয়ে উম্মে সালমা নিষেধ করায় মাবিয়া তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন। এরপর মাদক ব্যবসায়ী সুমন রবিদাসের সঙ্গে যোগসাজশ করে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন বাসায় ঢুকে উম্মে সালমাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর তিনজন মিলে লাশ ডিপ ফ্রিজে রেখে দেন।

গত রোববার দুপুরে দুপচাঁচিয়ার জয়পুরপাড়া এলাকায় ‘আজিজিয়া মঞ্জিল’ নামে চারতলা বাড়ির তিনতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে উম্মে সালমার লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি দুপচাঁচিয়া ডিএস ফাজিল মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ আজিজুর রহমানের স্ত্রী। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার এই দম্পতির ছোট ছেলে সাদ বিন আজিজুর ওই মাদ্রাসার আলিম প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

র‍্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার নিহত উম্মে সালমার ছোট ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমান। গত মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়ায় র‍্যাব-১২ কার্যালয়ে

র‌্যাব জানিয়েছিল ছেলের জড়িত থাকার কথা

এর আগে সোমবার রাতে উম্মে সালমার ছোট ছেলে সাদকে কাহালু উপজেলার আড়োবাড়ী গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। মঙ্গলবার দুপুরে ব্রিফিংয়ে র‍্যাব-১২-এর বগুড়া ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর মো. এহতেশামুল হক খান দাবি করেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

ব্রিফিংয়ে মেজর মো. এহতেশামুল হক খান দাবি করেন, রোববার সকালে সাদ তাঁর মা উম্মে সালমার কাছে হাতখরচের টাকা চান। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে সকালের নাশতা না খেয়েই মাদ্রাসায় চলে যান সাদ। বেলা ১১টার দিকে তিনি ক্লাসের বিরতিতে বাসার কাছাকাছি কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ান। একপর্যায়ে মাকে হত্যার কথা ভাবেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদ বাসায় গিয়ে দেখেন, তাঁর মা বঁটি দিয়ে তরকারি কাটছেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সাদ পেছন দিক থেকে মায়ের নাক-মুখ চেপে ধরেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মায়ের হাতে থাকা বঁটি লেগে ছেলের হাতের তর্জনীর নিচে সামান্য কেটে যায়। পরে সর্বশক্তি দিয়ে মায়ের নাক-মুখ দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন তিনি।

ব্রিফিংয়ে বলা হয়, হত্যার পর সাদ মায়ের দুই হাত ওড়না দিয়ে বেঁধে লাশ বাসার ডিপ ফ্রিজের ভেতর রেখে দেন। এরপর ডাকাতির ঘটনা সাজানোর জন্য বাসায় থাকা কুড়াল দিয়ে বাসার আলমারিতে কোপ মেরে কুড়াল সেখানে রাখেন। এরপর বাসার প্রধান ফটকে তালা দিয়ে বের হয়ে যান। পরে আবার বাসায় ঢুকে সাদ তাঁর বাবা আজিজুর রহমানকে মুঠোফোনে জানান, তাঁর মাকে বাসায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজিজুর রহমান দ্রুত বাসায় এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। খবর পেয়ে উম্মে সালমার ভাইসহ প্রতিবেশীরা ছুটে এলে সাদও খোঁজাখুঁজির নাটক করেন। একপর্যায়ে সাদ নিজেই ডিপ ফ্রিজের ঢাকনা খুলে লাশ বের করেন এবং এ ঘটনাকে ডাকাতি বলে চালানোর চেষ্টা করেন।

পুলিশ সূত্র পেয়েছে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে

দুপচাঁচিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উম্মে সালমা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর বড় ছেলে নাজমুস সাকিব বাদী হয়ে থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মঙ্গলবার মামলা করেছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর ছোট ছেলে সাদকে গ্রেপ্তারের পর থানায় হস্তান্তর করে র‍্যাব। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছেলে সাদ বিন আজিজুরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও মাকে হত্যার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন। প্রাথমিক তদন্তেও উম্মে সালমা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছেলে সাদের সম্পৃক্ততা মেলেনি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আরও বলেন, উম্মে সালমা হত্যাকাণ্ডের জট খুলে দিয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ। এর সঙ্গে আছে তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্য। সিসিটিভি ফুটেজে হত্যাকাণ্ডের দিন নতুন গ্রেপ্তার তিন আসামির ঘটনাস্থলে উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। মামলার তদন্ত নতুন মোড় নেওয়ায় উম্মে সালমা হত্যাকাণ্ডে ছেলে সাদ জড়িত নন বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বগুড়ার পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গৃহবধূ উম্মে সালমাকে দিনদুপুরে হত্যার পর লাশ রেফ্রিজারেটরে গুম করে রাখা হয়। এটি স্বাভাবিক হত্যাকাণ্ডের চেয়ে আলাদা। শুরু থেকেই পুলিশ এই “ক্লু-লেস” (সূত্রবিহীন) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমি নিজেও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে খুনিদের শনাক্তে থানা-পুলিশকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে এসেছি। র‍্যাব হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে উম্মে সালমার ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অন্যদিকে পুলিশের তদন্তে উম্মে সালমা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চারতলা ফ্ল্যাটের ভাড়াটে মাবিয়া সুলতানাসহ কয়েকজনের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। ইতিমধ্যে উম্মে সালমার মুঠোফোন, বাসা থেকে খোয়া যাওয়া ইন্টারনেট–সেবায় ব্যবহৃত রাউটারসহ বেশ কিছু আলামত গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে। হত্যা মামলাটি এখনো তদন্ত পর্যায়ে আছে। হত্যাকাণ্ডে কে জড়িত আর কে জড়িত নয়, সেটা সঠিক করে বলার সময় এখনো আসেনি। হত্যারহস্য পুরোপুরি উদ্‌ঘাটন হলেই পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে।’

এ ব্যাপারে র‌্যাব-১২ বগুড়া স্পেশাল কোম্পানির অধিনায়ক মেজর মো. এহতেশামুল হক খানের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।