‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ আয়োজনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন সংগীতশিল্পী প্রিয়াংকা গোপ ও তাঁর বাবা বাসুদেব চন্দ্র গোপ। বৃহস্পতিবার গাজীপুর মহানগরীর নাওজোড় এলাকায় আলেকজান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মিলনায়তনে
‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ আয়োজনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন সংগীতশিল্পী প্রিয়াংকা গোপ ও তাঁর বাবা বাসুদেব চন্দ্র গোপ। বৃহস্পতিবার গাজীপুর মহানগরীর নাওজোড় এলাকায় আলেকজান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মিলনায়তনে

‘বাবার দেখানো পথেই আজ এত দূর আসতে পেরেছি’

বাবার কাছে যদি চিঠি লেখা হয়, তবে সেখানে কী থাকবে? এর উত্তরে সংগীতশিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রিয়াংকা গোপ বলেন, ‘এখন যদি বাবাকে চিঠি লিখতাম, তবে আমি লিখে পাঠাতাম—প্রিয় বাবা, তোমার দেখানো পথেই আমি আজ এত দূর আসতে পেরেছি। দোয়া করি, তোমরা আমার থেকে বেশি দিন বেঁচে থাকো। যাতে এভাবেই নির্ভার হয়ে আমি আমার জীবন চালাতে পারি।’

প্রিয়াংকা গোপের বাবা সাবেক শিক্ষক ও বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির গাজীপুর জেলার আহ্বায়ক বাসুদেব চন্দ্র গোপ বলেন, ‘মেয়ের চিঠির প্রতি–উত্তরে আমি মেয়েকে লিখতাম—সত্য, ন্যায় এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এগিয়ে গেলে তোমার কখনোই কোনো সমস্যা হবে না। সেই আশীর্বাদ সর্বদা তোমার ওপর থাকবে।’

আজ বৃহস্পতিবার গাজীপুর মহানগরীর নাওজোড় এলাকায় আলেকজান বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের মিলনায়তনে ‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ আয়োজনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রিয়াংকা গোপ ও তাঁর বাবা বাসুদেব চন্দ্র গোপ। গল্পে গল্পে বাবা ও মেয়ে নিজেদের সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেন।

প্রথম আলো ডটকমের সহযোগিতায় জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘সেলিব্রিটিং ডটার্স’ ক্যাম্পেইনের আওতায় বিশেষ এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাবার সঙ্গে কেমন সম্পর্ক, এর উত্তরে বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার বলে, ‘আমি কী করি, আমার কী ভালো লাগে, সবকিছু বাবাকে বলি। আমি কখনো রাগ করলে বাবা আমাকে যেভাবেই হোক রাগ ভাঙাবে।’ আরেক শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার বলে, ‘সারা দিন যা হয় সবকিছু বাবাকে বলে দিই। বাবাকে মনের কথা না বললে মনে হয় পেটের ভাত হজম হয় না।’

বাবার কোন কথাটি বলা হয়নি, এমন প্রশ্নে মেয়ে প্রিয়াংকা গোপ বলেন, ‘বাবা বিকেলে বা সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতেন চা খেতে বা গল্পগুজব করতে। বাবা যখন ফিরতেন তার দরজার একটা বিশেষ টোকা ছিল, যার শব্দ শুনলেই বুঝতাম বাবা এসেছেন। তখন আমরা দৌড়ে গিয়ে পড়তে বসতাম। বাবা ঘরে ঢুকে খুব খুশি হয়ে বলতেন আর পড়তে হবে না, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।’

প্রিয়াংকা গোপ বলেন, ‘আমি যখন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সংগীতেও চান্স পেয়েছি, তখন আমার বাবাকে প্রশ্ন করা হলো—“আপনার মেয়ে সংগীতেও চান্স পেয়েছে, আপনি কী করবেন?” বাবা বললেন, ডাক্তার তো প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বের হয়, সংগীতশিল্পী কয়জন বের হয়। ওর ভেতরে মেধা আছে। আমার মনে হয়, পরিশ্রম করলে সে যা করবে সেটাতেই এক নাম্বার হবে।” বাবার এই কথা আমি এখনো মাথায় রাখি। বাবা একদম মা-বাবার কোল থেকে পাঠিয়ে দিলেন আমাকে দেশের বাইরে। শুধু সংগীত নিয়ে পড়ার জন্য। এর থেকে বড় কথা আর কী হতে পারে।’

বাসুদেব চন্দ্র গোপ বলেন, ‘আমার একটা উপদেশ আছে তোমাদের জন্য। তোমার-আমার মতোই শিশুসন্তান বড় হয়ে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। তাদের আমাদের চাইতে গায়ে শক্তিও বেশি না, রক্ত–মাংসও বেশি না। শুধু ইচ্ছাশক্তি যদি থাকে যে আমি এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে চাই, এটা সম্ভব। এটা আমার মেয়ে করে দেখিয়েছে। আমি কখনো ভাবিনি সংগীতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সে যাবে। নিজেকে মেয়ে বলে কখনো দুর্বল ভেবো না। তুমিও মানুষ। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সমভাবে ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন। পড়াশোনা করো এবং নিষ্ঠার সঙ্গে যে বিষয় ভালো লাগে, সে বিষয়ে নিজেকে তৈরি করো।’

প্রিয়াংকা গোপ আরও বলেন, ‘আমার ওপর বাবার প্রভাব অনেক বেশি। বাবার ব্যক্তিত্ব, তাঁর চলাফেরা, তাঁর পড়াশোনাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছি। যখন কোনো উদাহরণ দিই, সবকিছুতেই বাবার কথা আসে সব সময়। যত দিন আমি বেঁচে থাকব, তত দিন চাইব যেন আমার বাবা-মাও বেঁচে থাকেন। এভাবেই তাঁর স্নেহের হাত আমাদের মাথার ওপর থাকুক। অনেক গুরুতর বিষয় আমরা একদম হালকাভাবে নিই কেবল আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন বলেই।’

‘কথা হোক: বাবা-মেয়ের গল্প শুনি’ আয়োজনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অতিথিরা। গাজীপুর মহানগরীর নাওজোড় এলাকায় আলেকজান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মিলনায়তনে

অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রিয়াংকা গোপ ও তাঁর বাবা বাসুদেব চন্দ্র গোপকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান প্রথম আলোর চিফ ডিজিটাল বিজনেস অফিসার জাবেদ সুলতান পিয়াস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ‘সেলিব্রিটিং ডটার্স’ ক্যাম্পেইনের সমন্বয়ক সাইদুজ্জামান রওশন। গান ও কবিতা বলার জন্য ১০ শিক্ষার্থীকে আনিসুল হকের ‘কখনো আমার মাকে’ বই উপহার দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘দেশটা চালাতে যোগ্য লোক লাগবে। আমরা দেখছি, মেয়েরাই আমাদের দেশটাকে সুন্দরভাবে চালায়। কাজেই তোমাদের যোগ্য হতে হবে। সে জন্য তোমরা পড়াশোনা করবে, খেলাধুলা করবে আর মা–বাবার সঙ্গে কথা বলবে। এটা তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ।’

ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের অধ্যাপক অসীম বিভাকর বলেন, ‘আমাদের দুই মেয়ে, দুই মেয়ের মা নেই। শুধু একজনের অপূর্ণতা ছাড়া মেয়েদের নিয়ে ভালো আছি। এই দুই মেয়ে যদি আমার না থাকত, তাহলে আমার জীবনটা মরুভূমি হয়ে যেত। সব মেয়েদের জন্য শুভকামনা। ভালো থাকুক সব মেয়ে।’

মেয়েদের প্রতি বাবাদের টান বেশি থাকে বলে মনে করেন গীতিকার কবির বকুল। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই বলি যে মা সন্তানের সবচেয়ে বড় বন্ধু। কিন্তু কেন জানি মনে হয় বাবা সন্তানের বড় বন্ধু, বিশেষ করে সেই সন্তান যদি হয় মেয়ে। তাহলে তো কথাই নেই। তোমরা তোমাদের বাবার কাছে চিঠি লিখবে। প্রতিদিন স্কুলের জন্য বের হওয়ার সময় বাবাকে বলে বের হতে চেষ্টা করবে।’

বাবা–মেয়েদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনের গুরুত্ব তুলে ধরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) কর্মসূচি কর্মকর্তা আবু নাসের বলেন, ‘আমরা চাই বাবার সঙ্গে কথাটা শুরু হোক। দিনের যত ভালো বা মন্দ ঘটনা, সব বাবাকে বলব। রাস্তায় কেউ ইভ টিজিং করলে তা–ও বলব। বাবার চেয়ে বেশি সমর্থন করবে এমন আর কেউ নেই। এই সমর্থনটা আমাদের আদায় করে নিতে হবে। আদায় করার জন্য বাবার সঙ্গে কথা বলাটা শুরু করতে হবে।’

‘সেলিব্রিটিং ডটার্স’ ক্যাম্পেইনের এ বিশেষ উদ্যোগে বাবা–মেয়ের অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশ করতে পরস্পরকে চিঠি লেখার ‘কথা হোক’ নামের আয়োজনে পাঠকও অংশ নিতে পারবেন।

পাঠক তাঁর কন্যা/বাবার উদ্দেশে লেখা চিঠি celebratingdaughters.pro এই ওয়েব ঠিকানায় জমা দিতে পারবেন অথবা ayojon@prothomalo.com– এই ঠিকানায় ই–মেইল করতে পারবেন। আজই চিঠি পাঠানোর শেষ দিন। বাছাই করা চিঠি নিয়ে প্রকাশিত হবে বই। এ ছাড়া সেরা চিঠি লেখকদের জন্য বিশেষ পুরস্কারও থাকছে।