সুন্দরবনের মধু ভারতের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশে এ নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার মৌয়াল, ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা মনে করছেন, এতে এই পণ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হাতছাড়া হতে পারে।
সুন্দরবনের আয়তন ও মধু উৎপাদন—সবদিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। এরপরও ভারত কীভাবে আগে এ পণ্যের জিআই নিবন্ধন করতে পারল, তা নিয়ে বিস্মিত অনেকেই। এখন দ্রুত বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধুর জিআই সনদের দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের প্রত্যাশা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই দেশের অভিন্ন এই পণ্যের প্রতিযোগিতায় যেন কোনো জটিলতা সৃষ্টি না হয়, সরকারের উচিত সেই ব্যবস্থা করা।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) অবশ্য বলছে, শিগগিরই বাংলাদেশের জিআই পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সুন্দরবনের মধু।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক ২০১৭ সালে সুন্দরবনের মধুকে জিআই পণ্য করার জন্য আবেদন করেন। সাত বছর আগে করা সেই আবেদন পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংযুক্ত করে জার্নাল আকারে প্রস্তুতের পর গত ৩০ জুন বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়-বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছে। জার্নাল প্রকাশের তারিখ থেকে দুই মাসের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষের আপত্তি বা বিরোধিতা না পাওয়া গেলে পণ্যটিকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হবে।
ভারত ২০২১ সালে আবেদন করে সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বত্ব পেয়ে গেছে। সম্প্রতি বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার (ডব্লিউআইপিও) এক সম্মেলনে সুন্দরবনের মধুকে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই মধুর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে সুন্দরবনসংলগ্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শঙ্কা তাই বেড়েছে।
সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করা মোখতার গাজির (৫২) সাত পুরুষের পেশা। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বনসংলগ্ন সিংহরতলী গ্রামে। সুন্দরবনের মধুর জিআই স্বীকৃতি ভারত পাচ্ছে, এমন খবর চাউরের পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মৌমাছি ও মধু নামের একটি সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করেন।
মোখতার গাজি বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষের পেশা সুন্দরবন থেকে মধু কাটা। এই মধুর স্বীকৃতি আমরা চাই।’
মধু গবেষক সৈয়দ মো. মঈনুল আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিআই স্বীকৃতি পেলে বিশ্বে সুন্দরবনের মধুর একটা নতুন ব্র্যান্ডিং হবে।’
জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মধু ও মৌ পণ্য রপ্তানি করেন মো. এবাদুল্লাহ আফজার। তিনি মনে করেন, মধুর জিআই স্বীকৃতি না হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। সুন্দরবনের মধু জিআই স্বীকৃতি পেলে বিশ্ববাজারে একদিকে যেমন এর চাহিদা বাড়বে, তেমনি ভালো দামও পাওয়া যাবে।
কোনো দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে এবং ভৌগোলিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে সেই পণ্যগুলোকে ‘নিজস্ব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে সেটিকে ওই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে সে স্থানের নামও যুক্ত করা হয়।
দেশে ডিপিডিটি পণ্যের জিআই সনদ দেয়। দেশীয় স্বীকৃতির পর ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনে (ডব্লিউআইপিও) তা উপস্থাপন করা যায়। ডব্লিউআইপিও জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা। সম্প্রতি ডব্লিউআইপিওর এক সম্মেলনে সুন্দরবনের মধুকে ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবহেলার কারণে ভারত মধুর এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় বলে অভিযোগ তোলে। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্মেলনে বলেন, এমন অনেক পণ্য ভারত নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা বাংলাদেশেও উৎপাদিত হয়। এ বাস্তবতায় উভয় দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে জিআই বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থাকা উচিত।
ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের এমন অনেক পণ্য ও স্থান আছে, যেগুলোর বাংলাদেশের সঙ্গে মিল আছে। এর মধ্যে সুন্দরবনের মধু একটি। ইতিমধ্যে আটটি পণ্য ভারতে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশেও আছে। এগুলোর মধ্যে আছে পশ্চিমবঙ্গের মালদা ফজলি আম, মালদা লক্ষ্মণভোগ আম, মালদা ক্ষীরশাপাতি, নকশিকাঁথা, বাংলার রসগোল্লা, উপাধা জামদানি, গরদ শাড়ি ও সুন্দরবনের মধু।
এখন এই মধুর জিআই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শক্ত অবস্থানে আছে বলে মনে করেন ডিপিডিটির মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ভারত ২০২১ সালে আবেদন করে ২৪ সালে জিআই পেল, আমাদেরটা গণনা হবে ২০১৭ সাল থেকে।’
সুন্দরবনের মধুর জিআই পেতে আবেদনের পর সাত বছর বিলম্বের বিষয়ে মুনিম হাসান বলেন, এখানে সবকিছুর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র লাগে। সার্টিফিকেট ইস্যু করতে গেলে প্রয়োজনীয় সব নথি লাগে। কিন্তু এগুলো পেতে দেরি হওয়ায় এমনটা হয়েছে।