করতোয়ায় নৌকাডুবি

এক মাসেও খোঁজ মেলেনি তিনজনের, মা-বাবার জন্য কাঁদে দীপু

মাসির কোলে মা–বাবা হারানো শিশু দীপু
প্রথম আলো ফাইল ছবি

মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর তিন বছর বয়সী ছেলে দীপুকে নিয়ে নদী পার হচ্ছিলেন ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) ও রুপালি রানী (৩৬)। নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা তিনজনই। ঘটনার পর শিশু দীপু উদ্ধার হলেও নদীর পানিতে হারিয়ে যান ভূপেন-রুপালি দম্পতি। পরের দিন রুপালি রানীর লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ ভূপেন্দ্র নাথ।

এক মাসেও ভূপেন্দ্র নাথের খোঁজ না মেলায় গত শুক্রবার তাঁর প্রতীকী দাহ করেছেন স্বজনেরা। এমনকি সোমবার করা হয়েছে আনুষ্ঠানিক শ্রাদ্ধ। এক মাস ধরে মা-বাবাকে না পেয়ে মাঝেমধ্যেই কাঁদছে ছোট্ট শিশু দীপু। মা না থাকায় নদীতে ডুবে আহত হওয়া দীপুকে ওষুধ খাওয়াতে এখনো বেগ পেতে হয় স্বজনদের।

নৌকাডুবির ঘটনার আট দিন পর ৩ অক্টোবর ভোরে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ করে নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে গেলেও এখনো মাঝেমধ্যে ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন বোদা ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এক মাসেও আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি উদ্ধার অভিযান বন্ধের ঘোষণা।

এর আগে ঘটনার চতুর্থ দিন ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে সর্বশেষ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হয়েছিল। এরপর এখন পর্যন্ত নতুন কোনো লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী, নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ তিনজন হলেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার ঘাটিয়ারপাড়া এলাকার শিশু জয়া রানী (৪), দেবীগঞ্জ উপজেলার হাতিডোবা-ছত্রশিকারপুর এলাকার ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২) এবং বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া-কলেজপাড়া এলাকার সরেন্দ্র নাথ বর্মণ (৬৫)।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই মেয়ে, এক জামাতাসহ ছয় স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ। নৌকায় গাদাগাদি করে মানুষ ওঠায় সাতজনই ছিলেন খুব কাছাকাছি। মাঝনদীতে নৌকা ডুবে তলিয়ে যান তাঁরা। এ সময় বিনয় চন্দ্র বর্মণ (৪২) নামের তাঁদের এক স্বজন সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যান অপর ছয়জন। উদ্ধার অভিযানে দুই মেয়েসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ আছেন সরেন্দ্র নাথ বর্মণ। অন্য পাঁচ স্বজনের লাশের দাহ-শ্রাদ্ধ শেষ হলেও বাবার জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না সরেন্দ্রর সন্তানদের।

নৌকাডুবিতে আমরা তিন ভাই মা–বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেছি। আমরা দুই ভাই কিছুটা বুঝলেও তিন বছর বয়সী ছোট ভাই দীপুকে কোনোভাবেই বোঝানো যায় না। এখনো মাঝেমধ্যে সে কান্না করে ওঠে। নদীতে ডুবে গিয়ে তার কানে সমস্যা হয়েছিল, সেই চিকিৎসা এখনো চলছে। এখনো ওষুধ খাওয়াতে গেলে মা না থাকায় খুবই কান্নাকাটি করে সে।
দীপন চন্দ্র বর্মণ, শিশু দীপুর বড় ভাই

অন্যদিকে ওই দিন দুই মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন আলোশ্বরী রানী (২৪)। নৌকায় মানুষের ভিড়ে ছোট মেয়ে জ্যোতি রানীকে (২) নিজের কোলে রেখে বড় মেয়ে জয়া রানীকে (৪) দিয়েছিলেন তার নানির কোলে। মাঝনদীতে নৌকাডুবিতে তলিয়ে যান তাঁরা। এ সময় মায়ের কোল থেকে জ্যোতি আর নানির কোল থেকে জয়া পড়ে গিয়ে তলিয়ে যায় পানিতে। উদ্ধারকারীদের মাধ্যমে আলোশ্বরী রানী পাড়ে উঠতে পারলেও হারিয়ে যায় তাঁর দুই মেয়ে, মা, বোন ও কাকিমা। ঘটনার পর নদী থেকে ছোট মেয়ে জ্যোতিসহ অন্যদের লাশ উদ্ধার হলেও এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি জয়াকে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন থেকে ৩ অক্টোবর ভোর পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা ১২টি দলে বিভক্ত হয়ে উদ্ধার অভিযান চালান। এতে তাঁদের ৭০ জন সদস্য কাজ করেছিলেন। করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট থেকে দিনাজপুরের আত্রাই নদ পর্যন্ত প্রায় ৪২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ উদ্ধার অভিযান চলেছিল। নদীর পানির পাশাপাশি যেসব জায়গায় চর পড়েছে, সেসব স্থানে খোঁজ করছিলেন তাঁরা। বর্তমানে স্থানীয়ভাবে বোদা ফায়ার সার্ভিসের একটি টহল দল করতোয়া নদীর নৌকাডুবির এলাকা ও এর আশপাশে মাঝেমধ্যে টহল দিচ্ছে।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নৌকাডুবির ঘটনায় এখনো তিনজন নিখোঁজ থাকায় ফায়ার সার্ভিস তাদের টহল অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তিদের দেওয়া সরকারি–বেসরকারি অনুদানের সঙ্গে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদেরও সমানভাবে অনুদান দেওয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরও জানা যায়, ঘটনার দিন ৪৭ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থ (মাঝের অংশ) নৌকাটিতে মোট ১০৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। নৌকাডুবির পর সাঁতরে পাড়ে ওঠেন ৬ জন, জীবিত উদ্ধার হন ২৭ জন।

মা–বাবাকে হারানো কিশোর দীপন চন্দ্র বর্মণ (১৭) (শিশু দীপুর বড় ভাই) বলে, ‘নৌকাডুবিতে আমরা তিন ভাই মা–বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেছি। আমরা দুই ভাই কিছুটা বুঝলেও তিন বছর বয়সী ছোট ভাই দীপুকে কোনোভাবেই বোঝানো যায় না। এখনো মাঝেমধ্যে সে কান্না করে ওঠে। নদীতে ডুবে গিয়ে তার কানে সমস্যা হয়েছিল, সেই চিকিৎসা এখনো চলছে। এখনো ওষুধ খাওয়াতে গেলে মা না থাকায় খুবই কান্নাকাটি করে সে। মায়ের লাশটি পেয়েছি ঠিকই কিন্তু বাবাকে পাওয়া গেল না। এ জন্য গত শুক্রবার ব্রাহ্মণ ডেকে শ্মশানে গিয়ে সনাতন ধর্ম অনুযায়ী বাবার প্রতীকী দাহ (খড়ের তৈরি বস্তু দাহ করে) করেছি। আর সোমবার করেছি শ্রাদ্ধ।’