নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার মহাদেও নদ থেকে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রংছাতি ইউনিয়নের পাতলাবন এলাকায় ‘মহাদেও নদ রক্ষা কমিটি’ ও ‘রংছাতি ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনগণ’-এর ব্যানারে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে সহযোগিতা করে পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)।
এ ছাড়াও ব্যানার নিয়ে কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস), বাংলাদেশ গারো লিঙাম ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (গাসু), গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন (জিএসএফ), লিঙাম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, রংছাতি মানবতার সংগঠন, পাতলাবন গ্রাম উন্নয়ন কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন।
মহাদেও নদ রক্ষা কমিটির সভাপতি লুয়ের নংমিনের সভাপতিত্বে ঘণ্টাব্যাপী চলা কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন গারো লিঙাম ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুরঞ্জন হাজং, সাধারণ সম্পাদক পিটারসন কুবি, গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক রুবেল ঘাঘড়া, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সদস্য শফিকুল আলম, রংছাতি মানবতার সংগঠনের সভাপতি রিপন খান, পাতলাবনের বাসিন্দা সেলিনা ঘাঘড়া, আদিবাসী নেতা অঙ্কুর ঘাঘড়া, মোহন রংখেং প্রমুখ।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা চন্দন বিশ্বাস বলেন, ‘অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে আমি গত বছরের ২৬ এপ্রিল জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও রংছাতি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান তাহেরা খাতুন বলেন, মহাদেও নদের বালু এখন তাঁদের কাছে রীতিমতো দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর বাদী হয়ে আদালতে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা করেছিলেন। বালু ব্যবসায়ীরা খুবই প্রভাবশালী। বালু তুলতে বাধা দেওয়ায় তিন দিন আগে ডায়ারকান্দা বাজারে কয়েকজন বালু ব্যবসায়ী তাঁদের ওপর হামলা করেন।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতা পিটারসন কুবি বলেন, বালু ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো রকম নিয়ম–নীতি না মেনে ইজারাবহির্ভূত জায়গা থেকে শত শত ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু ও পাথর তুলছেন। এর ফলে নদের ভাঙনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেক পরিবার তাদের বসতভিটা হারাতে বসেছে।
এ বিষয়ে ইজারাদার চান মিয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পলাশ বিশ্বাস বলেন, বালুমহালের সীমানা নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। জেলা প্রশাসন থেকে যে স্থান কয়েক বছর ধরে বালুমহাল হিসেবে ইজারা দিয়ে আসছে সেখানে তেমন বালু নেই। ইজারাদার অনেক টাকা রাজস্ব হিসেবে জমা দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে অন্য স্থান থেকে বালু তুলছেন। তবে তিনি (পলাশ) বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাসেম প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইজারাবহির্ভূত স্থান থেকে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে বালু ও পাথর তোলার খবর পেয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। গত এক মাসে ১৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২০টি ড্রেজার মেশিন ধ্বংস, ৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ২ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
স্থানীয় ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহাদেও নদের ওমরগাঁও, হাসানোয়াগাঁও ও বিশাউতি মৌজায় ৩৫ দশমিক ১৫ একর বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়। ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকায় ইজারা পান মো. চান মিয়া নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু তিনি ইজারা দেওয়া নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বালু না তুলে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় সীমান্তবর্তী পর্যটন এলাকাখ্যাত মহাদেও, সন্ন্যাসীপাড়া, চিকনটুপ, বড়ুয়াকোনা, পাতলাবনসহ নদের বিভিন্ন এলাকা থেকে খননযন্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে বালু ও পাথর তুলছেন। ইজাদারের সঙ্গে যুক্ত আছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মানু মজুমদারের শ্যালক উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পলাশ বিশ্বাস, তাঁর ভাই সুজন বিশ্বাস, সাবেক যুবলীগ নেতা এরশাদুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি।
অবৈধভাবে বালু তোলায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্টের পাশাপাশি নদের তীরের বাড়িঘর, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু স্থাপনা ভাঙার উপক্রম হয়েছে। এ ছাড়া বালু ও পাথর পরিবহনের কারণে গ্রামের রাস্তাঘাট ভেঙে যাচ্ছে। অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবিতে স্থানীয় ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ, মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছে।