ঘটনাস্থলে সেদিন জড়ো হয়েছিল হাজারো মানুষ। এক সঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেননি
ঘটনাস্থলে সেদিন জড়ো হয়েছিল হাজারো মানুষ। এক সঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেননি

মিরসরাই ট্র্যাজেডি: সেদিন যেভাবে প্রাণ হারিয়েছিল ৪৩ শিশুসহ ৪৫ জন

বেঁচে থাকলে তারা সবাই এখন হতো টগবগে যুবক। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সংসারের হাল ধরে মা–বাবার মুখে হাসি ফুটাত অনেকে। কিন্তু ২০১১ সালের ১১ জুলাই ভয়াল সেই দিন কেড়ে নিয়েছিল ৪৫টি পরিবারের স্বপ্ন। সেদিন দুপুরে মিরসরাই উপজেলা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা উপভোগ করে বাড়ি ফেরার পথে পিকআপ উল্টে ডোবার পানিতে ডুবে অকালে ঝরে পড়ে ৪৩ ছাত্রসহ ৪৫টি তাজা প্রাণ।

এ দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীদের সবার বাড়ি উপজেলার মায়ানী ও মঘাদিয়া এলাকায়। একসঙ্গে এতগুলো শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যু সেদিন কাঁদিয়েছিল পুরো দেশবাসীকে। আজ সে ট্র্যাজেডির ১৩তম বার্ষিকী। শোকাবহ সেই দিনটি স্মরণে আজ আবু তোরাব উচ্চবিদ্যালয় ও স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন শোভাযাত্রা, স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেওয়া, দোয়া ও স্মরণসভার আয়োজন করেছে।

২০১১ সালের ১১ জুলাই মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে গিয়েছিল ৪৩ শিশুসহ ৪৫ জনের প্রাণ। মিরসরাইবাসী সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো

২০১১ সালের ১১ জুলাই উপজেলার আবু তোরাব সড়কের সৈদালী এলাকায় রাস্তার পাশের ডোবায় ট্রাক পড়ে গেলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। সেদিন মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখে একটি মিনি ট্রাকে গাদাগাদি করে ফিরছিল শিশুরা। নিহত শিশুদের মধ্যে ৩৪ জনই উপজেলার মায়ানী ইউনিয়নের আবু তোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। বাকিদের মধ্যে একজন ছাড়া অন্যরা মঘাদিয়া ও মায়ানী ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। কেউ মারা গেছে ঘটনাস্থলেই আবার কেউ কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েক দিন পরে। এ ঘটনায় নিহত ছাত্রদের স্মরণে দুর্ঘটনাস্থলে ‘অন্তিম’ ও আবু তোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ‘আবেগ’ নামে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর আজ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে একসঙ্গে এত শিশুর মৃত্যু ঘটেনি। ওই ঘটনার পর স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে শিশুদের পরিবারের সদস্য এবং ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। শোকের ধাক্কা ও ট্রমা কাটিয়ে ওঠার জন্য মনোবিদও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তখন।

জানতে চাইলে মায়ানী ইউনিয়নের সৌদালী এলাকার ইউপি সদস্য মো. ইয়াছিন উল্লাহ বলেন, ‘১১ জুলাই মিরসরাই ট্র্যাজেডির এই দিনটি আমাদের জন্য বড় শোকের। এই দিন মিরসরাই স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন শিশু শিক্ষার্থী ও ২ জন সাধারণ দর্শকসহ ৪৫ জন নিহত হয়েছিল। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে মায়ানী ও মঘাদিয়া এলাকায় ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়। ছেলে হারানো মা–বাবার আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মিরসরাই ট্র্যাজেডির এই দিনটিতে এখনো আমরা আমাদের অকালে হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের স্মরণ করি পরম মমতায়।’

দুর্ঘটনার পর ডোবায় নেমে শিশুদের খোঁজ করছে গ্রামবাসী

১১ জুলাইয়ের সেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাখাওয়াত হোসেন। একমাত্র ছেলে হারানোর সেই দিনটির কথা এক দিনের জন্যও ভুলে থাকতে পারেন না তার মা নাজমা আক্তার। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন ছেলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার সব স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়ে গেছে। বেঁচে থাকলে আমার ছেলে আজ টগবগে তরুণ থাকত। কিন্তু ছেলেটার বয়স তো আর বাড়ল না। যে ছেলে আমার অবলম্বন হতো, তার স্মৃতি হাতড়ে এখন দিন কাটে আমার। এ দুঃখ থেকে আমার আর মুক্তি নেই এ জীবনে।’