জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের অতিথিকক্ষে রাজনৈতিক বৈঠক চলাকালে ভিডিও ধারণের সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এক সাংবাদিককে বেধড়ক মারধর করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গতকাল রোববার দিবাগত রাত দুইটার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের মাঠে এ ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক আসিফ আল মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের ছাত্র। তিনি বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশে (ইউএনবি) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। এ ঘটনায় আজ সোমবার বিকেলে হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী আসিফ আল মামুন।
অভিযোগে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নাঈম হোসেন এবং আমিনুর সুমন, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪৮ ব্যাচের হৃদয় রায়, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শাফায়েত হোসেন এবং চারুকলা বিভাগের ৪৭ ব্যাচের মেহেদী হাসানের নাম উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও পাঁচ-সাতজন সরাসরি মারধরে অংশ নিয়েছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা সবাই বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমানের (লিটন) অনুসারী।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী আসিফ হলের ক্যানটিনে চা পান করছিলেন। হল গেটে কয়েকজন ছাত্রলীগের কর্মী হঠাৎ চোর চোর বলে কাউকে ধাওয়া করে। তাঁরা মাঠের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলে সাংবাদিক আসিফ আল মামুন কী হয়েছে সেটি দেখার জন্য দৌড়ে যান। এ সময় ধাওয়া করা ব্যক্তিরা আসিফকে পেয়ে বেধড়ক মারধর ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। আসিফ নিজেকে হলের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তাঁর শার্ট এবং জুতা ছিঁড়ে যায়। ‘সাংবাদিককে মারতে পেরেছে’ বলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন হামলাকারীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোববার রাতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে মোমবাতি প্রজ্বালন প্রোগ্রাম শেষে হলে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ চলছিল। ৪৭তম ব্যাচের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে গেস্টরুমে ছিল ৪৮, ৪৯ এবং ৫০ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। এ সময় বাইরে থেকে কেউ ভিডিও করছে, এমন সন্দেহে নেতা–কর্মীরা একজনকে ধাওয়া করে। এ সময় তাঁরা ওই সন্দেহজনক ব্যক্তিকে ‘চোর চোর’ বলে ধাওয়া করায় হলের মধ্যে উৎসুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় সাংবাদিক আসিফ হল মাঠে নেমে এলে তাঁকে মারধর করা হয়। সাংবাদিকরা গেস্টরুমে ভিডিও করতে পারেন, এমন সন্দেহে তাঁকে মারধর করা হয়।
ওই সাংবাদিককে মারধরের একটি ভিডিও প্রথম আলোর কাছে এসেছে। তবে অন্ধকার থাকায় ওই ভিডিওতে কারো ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মারধর করতে করতে বলতে শোনা যায় ‘এই ভিডিও করলি কেন’, ‘এই দৌড় দিলি কেন?’, ‘এই হলুদ সাংবাদিক’ ইত্যাদি। হলের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যায়, রাত ২টা থেকে ২টা ৮মিনিটের মধ্যে গেস্টরুম থেকে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীরা হলের গেট থেকে একজনকে ধাওয়া করছে। অজ্ঞাত সেই ছেলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের এদিকে–সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায়।
আকস্মিক এ ঘটনায় সাংবাদিক আসিফ আল মামুন বলেন, ‘হলগেটে কয়েকজন ছেলে হঠাৎ চোর চোর বলে কাউকে ধাওয়া করে। তাঁরা হলের মাঠ পেরিয়ে ক্যানটিনের দিকে আসতে থাকলে আমি মাঠের দিকে এগিয়ে যাই। এ সময় ধাওয়াকারীদের অগ্রভাগে থাকা একজন আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করেই মাথায় আঘাত করে বসে। এরপর অপর ধাওয়াকারীরাও আমাকে বেধড়ক মারধর ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ সময় আমি নিজেকে হলের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর আমিনুর সুমনের (বোটানি ৪৮) নেতৃত্বে আরেক দফা মারধর করা হয়। একপর্যায়ে আমার চশমা ভেঙে যায় এবং শার্ট ও জুতা ছিঁড়ে যায়। মারধরের পর মোহাম্মদ নাঈম হোসেন (বোটানি ৪৮) আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি গেস্টরুমের ওইখানে কী করেন?”। এ সময় তাঁদের সাংবাদিক মারতে পেরেছে বলে গর্বিত ও উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়।’
মারধরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অস্বীকার করেছেন। নাঈম হোসেন বলেন, মারধর শেষে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তবে সাংবাদিককে জেরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। আমিনুর রহমান বলেন, ‘চোর শুনে আমি দৌড়ে উপরে চলে যাই। পরে শুনেছি নিচে গন্ডগোল হয়েছে।’ এ ছাড়া হৃদয় রায়, শাফায়েত হোসেন ও মেহেদী হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
ঘটনার পর রাত আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ওয়ার্ডেন ও ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ এজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আসিফের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরা মর্মাহত। সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি, কয়েকজন শিক্ষার্থী দৌড়ে যাচ্ছে, তবে তাঁরা কোন সংগঠনের সেটি একটু পর্যবেক্ষণ করে বলতে হবে। এ ঘটনায় অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত থাকলে প্রমাণ সাপেক্ষে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান।