পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে প্রশ্ন

ভর্তি ফরম বিক্রির আয় থেকে ১৫২ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ কোটি ৪১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ভাগ করে নিয়েছেন।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ কয়েকজন ডিন ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রির টাকা থেকে ‘অযৌক্তিকভাবে’ বেশি টাকা সম্মানী হিসেবে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উপাচার্য হাফিজা খাতুন নিজেই নিয়েছেন ৮ লাখ ৫২ হাজার ৯৯৩ টাকা। আর সহ-উপাচার্য এস এম মোস্তফা কামাল খান ও কোষাধ্যক্ষ কে এম সালাহ উদ্দিন নিয়েছেন ৬ লাখ ৮২ হাজার ৩৮২ টাকা করে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি থেকে আয় হয়েছিল ১ কোটি ৯৫ লাখ ৯৪ হাজার ৬০০ টাকা। এর মধ্যে ১৫২ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ কোটি ৪১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন।

ভর্তি পরীক্ষার তহবিল থেকে এত বেশি টাকা সম্মানী হিসেবে নেওয়ায় এর সমালোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সহযোগী অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবনে এত টাকা সম্মানী নেওয়ার কথা কোনো দিন শুনিনি। এত টাকা সম্মানী নেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক না।’

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ৪০ শতাংশ টাকা জমা দেওয়ার নিয়ম উঠে গেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে টাকা বণ্টন করা হয়, তার চেয়েও অতিরিক্ত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এখানে টাকা বণ্টন করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এস এম মোস্তফা কামাল খান

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি সূত্র জানায়, উপাচার্যদের সঙ্গে ইউজিসির এক সভায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফি আনুপাতিক হারে কমিয়ে ‘যৌক্তিক’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন ঠিক হয়েছিল, ফি কমিয়ে যৌক্তিক করলে আগে যেভাবে ভর্তি ফি বাবদ আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিতে হতো, সেটি দিতে হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকেরা বলছেন, পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির জন্য পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে ফি নিয়েছে, তা তুলনামূলকভাবে বেশি। পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে দায়িত্ব পালনের সম্মানী গ্রহণের ক্ষেত্রে ইউজিসির ওই সিদ্ধান্ত মানা হয়নি এখানে। ওই সিদ্ধান্ত মানা হলে ভর্তি ফরম বিক্রি করে আয় হওয়া টাকার ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা হতো; কিন্তু সেটা হয়নি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এস এম মোস্তফা কামাল খান প্রথম আলোকে বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে ৪০ শতাংশ টাকা জমা দেওয়ার নিয়ম উঠে গেছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে টাকা বণ্টন করা হয়, তার চেয়েও অতিরিক্ত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এখানে টাকা বণ্টন করা হয়েছে।

মাস্টাররোল থেকে উচ্চপদস্থ যাঁরা ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন ও কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যেই এই টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যাঁরা বেশি কাজ করেছেন, তাঁরা একটু বেশি টাকা পেয়েছেন।
উপাচার্য হাফিজা খাতুন

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষাটি ২০২২ সালের ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষায় ১৭ হাজার ৪৩৮ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন। এ, বি, সি—এই তিন ইউনিটে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা নেওয়া হয়।

গত এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব কার্যালয় থেকে ক্যাম্পাসে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের শাখায় টাকা বণ্টনের জন্য একটি তালিকা পাঠানো হয়। এতে স্বাক্ষর করেছেন উপাচার্য হাফিজা খাতুন। ওই তালিকা থেকে জানা গেছে, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার হিসাব নম্বর থেকে দুটি চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ৪১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬৭ টাকা মোট ১৫২ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর নিজ নিজ ব্যাংক হিসাবে নেওয়া হয়েছে।

ইউজিসির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষ কর্মকর্তারাই যদি ৭-৮ লাখ টাকা করে সম্মানী নেন, সেটি যৌক্তিক হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে টাকা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহার করা যেত।

উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ ছাড়া বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. খায়রুল আলম ৪ লাখ ৫ হাজার ৩৮০ টাকা, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মো. হাবিবুল্লাহ্ ৩ লাখ ১০ হাজার ৮৮০ টাকা, জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রাহিদুল ইসলাম ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৭৭ টাকা, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন ও ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার সরকার ২ লাখ ৬২ হাজার ৯৭৮ টাকা, বাণিজ্য অনুষদের সাবেক ডিন ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৫ টাকা, জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৯১ টাকা এবং ভর্তি পরীক্ষার অর্থ কমিটির আহ্বায়ক আব্দুর রহিম সম্মানী বাবদ নিয়েছেন ২ লাখ ৬ হাজার ১৯৮ টাকা। ঊর্ধ্বতন এই ১০ জন শিক্ষক সম্মানী বাবদ ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন।

জানতে চাইলে উপাচার্য হাফিজা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, মাস্টাররোল থেকে উচ্চপদস্থ যাঁরা ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন ও কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যেই এই টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যাঁরা বেশি কাজ করেছেন, তাঁরা একটু বেশি টাকা পেয়েছেন। ডিনরা বেশি কাজ করায় তাঁদের টাকার অঙ্কটা একটু বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মনীতি মেনেই এই টাকা বণ্টন করা হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

ভর্তি পরীক্ষা তহবিল থেকে ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, কেউ কেউ ভর্তি পরীক্ষার তহবিল থেকে অন্য তহবিলে টাকা জমা রাখে। তিনিও মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক একটি তহবিল করেছেন। সেখানে কিছু টাকা রাখা হয়েছে। তবে সেই টাকার পরিমাণ কত, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানাননি।

তবে ইউজিসির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা দেওয়ার বিষয়টি ছাড় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই টাকা যৌক্তিকভাবে খরচ করতে হবে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষ কর্মকর্তারাই যদি ৭-৮ লাখ টাকা করে সম্মানী নেন, সেটি যৌক্তিক হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে টাকা শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহার করা যেত।