টেকনাফে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল

নাগরিকত্ব প্রদান, জন্মভিটায় পুনর্বাসন না হলে ফিরবে না কোনো রোহিঙ্গা

নাফ নদী অতিক্রম করে কক্সবাজারের টেকনাফের চৌধুরীপাড়া জেটিঘাটে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল। প্রত্যাবাসন নিয়ে দলটি রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৃহস্পতিবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে আজ বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে টানা সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠক করেছেন মিয়ানমার থেকে আসা দেশটির ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল। বৈঠকে প্রত্যাবাসনের পক্ষে নানা যুক্তি ও সুযোগ–সুবিধা তুলে ধরে তারা। কিন্তু রোহিঙ্গা নেতারা নাগরিকত্ব প্রদান, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটাতে পুনর্বাসন, স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দাবি করে বলেন, এসব দাবি বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে রাখাইনে ফিরতে রাজি হবে না।

প্রত্যাবাসনের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন করতে ১৪ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদলটি বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টায় নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ পৌঁছান। এরপর প্রতিনিধিদলের সদস্যরা টেকনাফের জাদিমুরা ও পাশের শালবাগান রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেন। এই দুটি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা রয়েছে প্রায় ৭০ হাজার। বৈঠক শেষে বেলা সাড়ে তিনটায় দলটি মিয়ানমারে ফিরে গেছে।

বেলা ১১টার দিকে শালবাগান আশ্রয়শিবিরে একটি সেন্টারে ২৮০টি রোহিঙ্গা পরিবারপ্রধানের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত (সাড়ে তিন ঘণ্টা) বৈঠকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের যে ১৫টি গ্রামে পুনর্বাসনের প্রকল্প এবং সেখানে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকবে সে সম্পর্কে তুলে ধরে। প্রতিনিধিদল জানায়, রোহিঙ্গারা রাখাইনে পৌঁছার পর তাঁদেরকে প্রথমে এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফেকেট) দেওয়া হবে। পরে নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হবে। তখন স্বাধীনভাবে চলাফেরা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ চাকরির সুযোগ–সুবিধা পাবে রোহিঙ্গারা।

প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির মিনিস্ট্রি অব সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ। এই দলের সঙ্গে যুক্ত হন ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতাবাসের কর্মকর্তা অং ক্যা মি। বৈঠকে অন্তত ১৫-১৬ জন রোহিঙ্গার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতারা।

এ সময় কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা প্রতিনিধিদলের উদ্দেশে বলেন, প্রত্যাবাসন শুরুর আগে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এনভিসির পরিবর্তে এনআইডি দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিজ ভিটা-বাড়িতে পুনর্বাসন করতে হবে। মিয়ানমারের ১৩৫ সম্প্রদায়ের মানুষের মতো রোহিঙ্গাদের চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে। অন্যথায় কোনো রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হবে না।

কক্সবাজারের টেকনাফ শালবাগান আশ্রয়শিবিরের একটি সেন্টারে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের বৈঠক। বৃহস্পতিবার দুপুরে

বৈঠক শেষে রোহিঙ্গা মোহাম্মদ তাহের ও রহিমা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, এত বৈঠকের দরকার কী? মিয়ানমার সরকার যদি সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায়, তাহলে নাগরিকত্ব প্রদান এবং নিজ গ্রামে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিলেই হয়। এই দুটি দাবি মেনে নিলে কক্সবাজারের সব রোহিঙ্গা দল বেঁধে রাখাইনে ফিরে যাবে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হাসান বারী নূর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংসের মহাপরিচালক মাইনুল কবির, অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মুহাম্মদ সামছু-দ্দৌজাসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা।

মোহাম্মদ মিজানুর প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠকে কিছু রোহিঙ্গা ফিরে যাওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক এবং কিছু রোহিঙ্গা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এর মধ্যে যারা ইতিবাচক, তাদের নিয়ে শিগগিরই প্রত্যাবাসন শুরু হবে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের বুঝাতে চেয়েছেন এনভিসি কার্ড দিয়ে ফেরত নিলেও তাদের সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হবে।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংসের মহাপরিচালক মাইনুল কবির। তিনি বলেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সবাইকে জানিয়েই এই প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। কাজেই এতে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো চাপ নেই।

আরআরআরসি কার্যালয় সূত্রমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের অপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করেন।

প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের জন্য তাঁদের (রোহিঙ্গা) ২০ জনের প্রতিনিধিদলকে ৫ মে রাখাইনের পরিস্থিতি দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। এখন টেকনাফে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে মিয়ানমার।

৫ মে টেকনাফের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল রাখাইন রাজ্য ঘুরে এসে গণমাধ্যমকে জানায়, প্রত্যাবাসন শুরু করার মতো পরিস্থিতি সেখানে রাখাইনে নেই। মংডুতে কয়েক শ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসনের জন্য দুটি ‘মডেল ভিলেজ’ নির্মাণ করা হলেও সেখানে রোহিঙ্গারা থাকতে রাজি হবে না। প্রত্যাবাসন শুরুর আগেই নাগরিকত্ব প্রদানের ঘোষণা দিতে হবে মিয়ানমারকে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলে রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভন্ডুল হয়।