খুলনায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা: হামলাকারী ও ভুক্তভোগী সবাই আওয়ামী লীগের

নির্বাচন–পরবর্তী সহিসংতায় চিকিৎসা নিচ্ছেন খুলনার রূপসা উপজেলার কুদির বটতলা এলাকার দেবপ্রসাদ কুন্ডু
ছবি: সংগৃহীত

খুলনার ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটিতেই নৌকা প্রতীকের শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ভোট গ্রহণের দিন তিনটি আসনে সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। সেদিন বড় কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ইতিমধ্যে অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারও বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তালা, হত্যা ও এলাকাছাড়া করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিজয়ী নৌকার সমর্থক ও আওয়ামী লীগের নেতারা এসব হামলা ও হুমকির সঙ্গে জড়িত। হামলা ও হুমকির ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিতে গেলেও গ্রহণ করা হচ্ছে না। একাধিক প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন,  প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের লোক। যাঁদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাঁরাও আওয়ামী লীগের। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করছেন তাঁরা। দিন যত বাড়ছে, হামলার পরিমাণ তত বাড়ছে।

খুলনার ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ ১১টি রাজনৈতিক দলের ২৯ জন ও স্বতন্ত্র হিসেবে ১০ জন প্রার্থী অংশ নেন। নির্বাচনে খুলনা-১, ২ ও ৩ আসনে নৌকার বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে নৌকা। অন্যদিকে খুলনা-৪, ৫ ও ৬ আসনে ছিল বিপরীত চিত্র। এখানে নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র হিসেবে আওয়ামী লীগের তিন নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই তিন প্রার্থীর হয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের ওপরই মূলত হামলার ঘটনা ঘটছে।

খুলনা-৪ আসনে (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন শিল্পপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। তাঁর বিপরীতে কেটলি প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা রশিদী সুজার ভাই এস এম মোর্তজা রশিদী দারা। মোর্তজা রশিদীর হয়ে নির্বাচনী কাজ করেছিলেন তেরখাদা উপজেলার ছাগলাদাহ ইউনিয়নের কুদলা গ্রামের রিলি বেগম ও তাঁর স্বামী মোহাম্মদ এসকেন্দ শেখ।

রিলি বেগম ও এসকেন্দ শেখ কুদলা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে মোর্তজা রশিদীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। নির্বাচনের দিন ভোট গণনা শুরুর কিছুক্ষণ পর তাঁদের ওপর সশস্ত্র হামলা হয়। এসকেন্দ শেখকে কুপিয়ে জখম করা হয়। বর্তমানে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রিলি বেগম প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। রিলি বেগম অভিযোগ করে বলেন, হামলার ঘটনায় তেরখাদা থানায় মামলা করতে গেলেও তা নেওয়া হয়নি। এখন তিনি আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

একই উপজেলার আজগড়া এলাকায় কেটলি প্রতীকের হয়ে কাজ করেছিলেন মো. আবদুল কুদ্দুস তালুকদার ও তাঁর মেয়ে শিল্পী বেগম। নির্বাচনের পরদিন তাঁদের ওপর হামলা করেন নৌকার সমর্থকেরা। বেদম মারধর করার পর তাঁরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

রূপসা উপজেলার নৌহাটি ইউনিয়নের ইলাইপুর গ্রামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল সিরাজুল ইসলামের। নির্বাচনের পরদিন নৌকার লোকজন তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটিতে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। সিরাজুল প্রথম আলোকে বলেন, শুধু স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে কাজ করার কারণে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি এলাকা ছেড়ে খুলনায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্তজা রশিদী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় অন্তত ৩০ জনের বেশি মানুষের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে থানা ও পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করলেও হামলা থামানো যাচ্ছে না। প্রশাসন থেকেও হামলা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। বিপরীতে ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন। নির্বাচনে আকরাম হোসেনের হয়ে কাজ করেছিলেন শোভনা ইউনিয়নের মো. আবদুর রহিম ও তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। ভোট গ্রহণের পরদিন সকালে আবদুর রহিমের বাড়িতে হামলা করেন নৌকার নেতা–কর্মীরা। কিন্তু আবদুর রহিমকে বাড়িতে না পেয়ে তাঁর স্ত্রীকে বেধড়ক মারধর করেন। সাবিনা ইয়াসমিন বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ভোট গ্রহণের পরদিন সকালে আবদুর রহিমের বাড়িতে হামলা করেন নৌকার নেতা–কর্মীরা। কিন্তু আবদুর রহিমকে বাড়িতে না থাকায় তাঁর স্ত্রীকে বেধড়ক মারধর করা হয়

আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, হামলার ঘটনায় ডুমুরিয়া থানায় মামলা করতে গেলেও মামলা নেওয়া হয়নি। এখন তাঁদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী আকরাম হোসেন বলেন, স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না—দলীয় প্রধানের এমন আশ্বাসে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরাও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মী। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ডুমুরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঈগল প্রতীকের নেতা–কর্মীদের ওপর একের পর এক হামলা হচ্ছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। মানুষ ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে।

খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন পাইকগাছার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রশীদুজ্জামান। তাঁর বিপরীতে ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জি এম মাহবুবুল আলম। নির্বাচনের পরে পাইকগাছার গড়াইখালী ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অনেককে মারধর করা হয়েছে। কাউকে কাউকে বাড়িছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

গড়াইখালী ইউনিয়নের সাফায়েত ইসলাম বলেন, যাঁরা নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছিলেন, তাঁদের বিভিন্নভাবে মারধর ও হেনস্তা করা হচ্ছে। বাড়ির বাইরে গেলে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ কচি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌকার বিপক্ষে স্বতন্ত্র হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচন করে অনেকে বিপাকে পড়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতা–কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে জানতে পারছি। আসলে যাদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাঁরাও আওয়ামী লীগের লোক। কেন্দ্র থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। এ জন্য জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।’

খুলনার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ বারবার অভিযোগ চেয়েও অভিযোগ পাচ্ছে না। নির্বাচনের পর তেরখাদায় দুটি ও দিঘলিয়ায় একটি ঘটনা ঘটেছে। দিঘলিয়ার ঘটনায় মামলা হলেও বাকি দুটি ঘটনায় অভিযোগ পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে তাঁরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছেন। নির্বাচন–পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন।