বাংলাদেশ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এর প্রভাবে আজ রোববার সকাল থেকে পটুয়াখালীতে মেঘলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর। উপকূল এলাকায় মাইকিং করে সবাইকে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এরই মধ্যে পটুয়াখালী থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তরীণ নদীপথে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং তাদের কাছের দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরই মধ্যে পটুয়াখালী জেলার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবকেরা মাঠে নেমেছেন। দশমিনা উপজেলার সিপিপির প্রশিক্ষক রায়হান সোহাগ বলেন, শনিবার রাতে ও আজ রোববার সকাল থেকে তাঁদের স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে সবাই সতর্ক করে প্রচার চালাচ্ছেন। বিশেষ করে দশমিনার উপকূলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে মাইকিং শুরু করেছেন।
রায়হান সোহাগ আরও বলেন, এলাকায় মাইকিং করে নিরাপদে আশ্রয় আসার কথা বললেও এখনো বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে আসেননি লোকজন। তবে বিচ্ছিন্ন এলাকার বাসিন্দারা নিরাপদে আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দশমিনা উপজেলা থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চর হাদী ও চর শাহজালাল থেকে বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশুদের আশপাশের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে আসার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে চরের গবাদিপশুগুলো নিরাপদ স্থানে নেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।
গলাচিপা উপজেলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদে আনতে সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা মাইকিং করছেন। গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহিউদ্দিন আল হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন আগুরমুখা নদীতে জেগে ওঠা চর কারফারমার, চর নজীর, মুক্তিযোদ্ধার চরসহ আগুনমুখা নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের নিরাপদে আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য তাঁরা কাজ করছেন। সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা আজ সকাল থেকেই মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয়ে যেতে বলছেন। ইতিমধ্যে বিচ্ছিন্ন ও নদীর পাড়ের লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে শুরু করেছেন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় প্রস্তুতি হিসেবে ৭০৩টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও ৩৫টি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিপিপির ৮ হাজার ৭৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে থাকবেন। দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি তাঁরা নিয়ে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৪ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জিআর চাল বরাদ্দ হয়েছে ৭৩০ মেট্রিক টন। শুকনো খাবার ১ হাজার ৫০০ প্যাকেট প্রস্তুত রাখা হয়েছ। শিশুখাদ্য বাবদ ১০ লাখ টাকা এবং গোখাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কুয়াকাটা সৈকত থেকে সরানো হয়েছে ভ্রাম্যমাণ দোকান, আতঙ্ক
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। সাগর থেকে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। উপকূলের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বেড়েছে বাতাসের বেগ। এরই মধ্যে কুয়াকাটা সৈকত থেকে ভ্রাম্যমাণ সব দোকানপাট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
গতকাল শনিবার রাত থেকে কুয়াকাটাসহ কলাপাড়া উপজেলাজুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কলাপাড়ার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষ করে যেসব কৃষক গ্রীষ্মকালীন সবজিসহ আউশ ধানের বীজতলা করেছেন, তাঁরা বেশি ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। লতাচাপলী, নীলগঞ্জ, চম্পাপুর ও চাকামইয়া ইউনিয়নে বেশ কিছু আমবাগান আছে। এসব বাগানের আম ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছেন বাগানমালিকেরা।
আজ রোববার সকালে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য উপজেলার ১৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ২০টি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র এলাকার ১৫০টি বহুতল আবাসিক হোটেলের ভবনগুলোতেও মানুষের আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানুষকে সচেতন করতে ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে কলাপাড়া উপজেলার ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৩ হাজার ১৬০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।
ইউএনও মো. রবিউল ইসলাম জানান, কলাপাড়া উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ইতিমধ্যে ২ হাজার ২০০ দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। পুলিশ, আনসার ও সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করেছেন।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের খবরে কলাপাড়া উপজেলার সাগর মোহনার মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর ও রাবনাবাদপারের চম্পাপুর ইউনিয়নের দেবপুর গ্রামের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিক মুন্সি বলেন, ‘আমাগো গ্রামের বাঁধটা ঝুঁকিপূর্ণ। এর কারণ হইলো এই বাঁধটা একেবারে সাগরের মোহনায়। পানির চাপ বাড়লে এই বাঁধের গায়ে লাগব। যদি বাতাসের চাপ বাড়ে, বাঁধটা ছুইট্যা যাইব। বাঁধটি ছুইট্যা গেলে মহিপুর ইউনিয়নের নিজামপুর, পুরান মহিপুর, মনোহরপুর, ইউসুফপুর ও কোমরপুর গ্রাম তলায় যাইব, মানুষের ক্ষতি হইব।’
চম্পাপুর ইউনিয়নের দেবপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মাহবুব আলম বলেন, রাবনাবাদ নদের পারের গ্রামটির নাম দেবপুর। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সব সময়ই এ গ্রামের পাশের বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ২০ বছরে গ্রামটির অন্তত ৩ কিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী এবং তাদের কাছের দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।