আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে টাঙ্গাইলে দলটির ২৩ নেতা আগ্নেয়াস্ত্রের ২৭টি লাইসেন্স পেয়েছিলেন। এই নেতাদের চারজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও অন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৫ বছর যেসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তা স্থগিত করে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির এবং তাঁর ভাই টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি গোলাম কিবরিয়া ওরফে বড় মনি তাঁদের চারটি অস্ত্র এখনো জমা দেননি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের ইস্যুকৃত এসব অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত নয়, বাতিলের দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
হত্যা মামলার আসামি পান শটগানের লাইসেন্স
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জামিলুর রহমান ওরফে মিরন শটগানের লাইসেন্স পান। জামিলুর ওই সময়ই আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুর রহমান খান ওরফে বাপ্পী হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। এখনো মামলাটি টাঙ্গাইল প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দয়রা জজ আদালতে সাক্ষী গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আরও প্রায় ৪০টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে।
দুই হত্যা মামলা প্রত্যাহারের পর তিন ভাই পান ৪ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স
২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান ওরফে রানা পিস্তলের লাইসেন্স পান। এর ২৫ দিন আগে শটগানের লাইসেন্স পান আমানুরের ছোট ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুর রহমান খান ওরফে মুক্তি। সহিদুর ওই বছর ৭ মার্চ রিভলবারেরও লাইসেন্স পান। তাঁদের অপর ভাই ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান ওরফে কাকন ওই বছরের (২০১৪) ৬ জুলাই রিভলবারের লাইসেন্স পান। ওই লাইসেন্স নিয়ে তিনি অত্যাধুনিক উজিগান ক্রয় করেন। সেটি টাঙ্গাইল সদর থানায় জমা আছে।
তিন ভাইয়ের সবাই জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি আবদুর রউফ ও পৌর কমিশনার রুমি চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার কিছুদিন আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ওই দুই হত্যা মামলা প্রত্যাহার করে। এ ছাড়া আমানুরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় একাধিক হত্যাসহ ৪৫টি, সহিদুরের বিরুদ্ধে প্রায় ৩৫টি এবং জাহিদুরের বিরুদ্ধে অন্তত ৫টি মামলা হয়েছে। তাঁরা সবাই বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামি। টাঙ্গাইলের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির সাক্ষীর পর্যায়ে রয়েছে।
চার অস্ত্র জমা দেননি সাবেক সংসদ সদস্য ও তাঁর ভাই
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির। এর আগের মাসে তিনি ৭ নভেম্বর শটগানের এবং ২৬ নভেম্বর পিস্তলের লাইসেন্স পান। তাঁর ভাই গোলাম কিবরিয়া ওরফে বড় মনি ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই শটগানের এবং ২০১৭ সালের ৪ জুলাই পিস্তলের লাইসেন্স পান।
তানভীর হাসানের বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি মামলা হয়েছে। গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের একটি মামলায় গোলাম কিবরিয়ার কারাদণ্ডও হয়েছিল। তিনি তখন জার্মানপ্রবাসী ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০১০ সালে তাঁর সাজা রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেন।
গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই দুই ভাই তাঁদের চারটি অস্ত্রের একটিও জমা দেননি। তবে গত ১২ আগস্ট সদর থানায় তাঁদের বাবা আবদুল গফুর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন গত ৪ আগস্ট তাঁর বাড়িতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনতা হামলা করে। সে সময় বাড়ির সব জিনিসপত্র লুটপাট হয়। ওই সময় তাঁর দুই ছেলের লাইসেন্সকৃত চারটি অস্ত্রও লুট হয়ে যায়।
সংসদ সদস্যরা নেন অস্ত্রের লাইসেন্স
অনুপম শাজাহান জয় ২০১৪ সালের মার্চে টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছর ১৭ অক্টোবর তিনি রিভলবারের লাইসেন্স পান।
টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ছানোয়ার হোসেন। ওই বছর ১০ ডিসেম্বর তিনি পিস্তলের লাইসেন্স পান। পরের বছর ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল তিনি শটগানের লাইসেন্সও পান।
টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) সাবেক সংসদ সদস্য মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একাব্বর হোসেন ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর ছোট অস্ত্রের লাইসেন্স পান। ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট ছোট অস্ত্রের লাইসেন্স পান টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য খন্দকার আব্দুল বাতেন। দুজনেই মৃত্যুবরণ করেছেন।
একাব্বর হোসেন ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। পরে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা যুবলীগের তৎকালীন সহসভাপতি খান আহমেদ শুভ। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগেই ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি শটগানের এবং ২০১৮ সালের ২২ জুলাই পিস্তলের লাইসেন্স পান। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খানের ছেলে।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাছান ইমাম খান ওরফে সোহেল হাজারী ২০১৭ সালের ৩ মে পিস্তলের লাইসেন্স পান।
উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র-কাউন্সিলররাও নেন অস্ত্রের লাইসেন্স
গোপালপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ওরফে ঠান্ডু ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট, সখীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শওকত সিকদার ২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল, ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি পিস্তলের লাইসেন্স পান। সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন ওরফে মানিক ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ শটগানের লাইসেন্স পান।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা জামিলুর রহমান শটগানের লাইসেন্স পান। ভূঞাপুর পৌর মেয়র এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুদুল হকের নামে পিস্তলের লাইসেন্স ইস্যু হয় ২০১৫ সালের ৭ মে। ২০১৬ সালের ১৫ জুন টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন প্যানেল মেয়র সাইফুজ্জামান সোহেল পিস্তলের লাইসেন্স পান। এই লাইসেন্সে তিনি উজিগান ক্রয় করেন। ২০০০ সালে তিনি শটগানেরও লাইসেন্স নেন। জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামান ফারুক ২০১২ সালের মে শটগানের লাইসেন্স নেন।
নেতাদের স্বজনেরাও পেয়েছেন অস্ত্রের লাইসেন্স
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মির্জা তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে মির্জা খালিদ হোসেন ২০১১ সালের ২৩ জুলাই পিস্তলের লাইসেন্স পান। সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের মামাতো ভাই খন্দকার তারেকুল ইসলাম ২০১৯ সালের ২৩ জুন এবং মধুপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার আলম খান ওরফে আবুর জামাতা নুরুল আলম খান ওরফে রাসেল ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট পিস্তলের লাইসেন্স পান। এ ছাড়া মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি পরিমল গোস্বামী ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর পিস্তলের লাইসেন্স পান। তবে অস্ত্র কেনার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
স্থগিত নয়, লাইসেন্স বাতিলের দাবি
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন তাঁদের অনেকের অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার রয়েছে। বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সের আড়ালে তাঁরা অবৈধ অস্ত্রও ব্যবহার করতেন। তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স শুধু স্থগিত নয়, স্থায়ীভাবে বাতিলের পদক্ষেপ নিতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের টাঙ্গাইলের সমন্বয়ক এস এম কামরুল ইসলাম বলেন, গত জুলাই ও আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নোঁ–কর্মীরা তাঁদের অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে তাঁদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তরুণ ইউসুফ বলেন, তদন্ত করে এদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল করা প্রয়োজন।
হত্যা মামলার আসামিদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া ও অস্ত্র জমা না দেওয়া প্রসঙ্গে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে সানতু বলেন, আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের নির্দেশনা ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।