দিন দিন সবজির বাজার লাগামহীন হয়ে পড়ায় নিম্ন আয় ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই দুর্ভোগে পড়েছেন।
কুমিল্লা নগরের অন্যতম প্রধান কাঁচাবাজার রাজগঞ্জ বাজারে ৪০ বছর ধরে সবজি বিক্রি করছেন ষাটোর্ধ্ব চারু মিয়া। বর্তমানে সবজির দাম আকাশচুম্বী দেখে ক্রেতাদের মতো তিনিও অস্বস্তিতে আছেন। অবস্থাটা এমন হয়েছে, দোকানে আসা অনেক ক্রেতা সবজির দাম শুনেই চারু মিয়ার সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্রেতাই সবজির দাম শুনে আঁতকে উঠে উল্টো হাঁটছেন।
গতকাল শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চারু মিয়া বলেন, ‘কাস্টমাররে কিতা কইতাম, আমি নিজেই বিশ্বাস করতাম পারতাছি না সবজির এত দাম কেমনে হইতারে। এক কেজি শিমের দাম ৩১০ টাকা, ফুলকপি ২৪০ টাকা, টমেটো ২৬০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪৫০ আর ধনেপাতা ৪৮০ টাকা। ৪০ বছর ধরই সবজি বেচতাছি, এত দাম আমার জীবনেও দেহি নাই। কাস্টমার আইয়া দাম হুনলেই চিল্লাচিল্লি করে। আমরা কিতা করতাম। আমরা তো বেশি দামে কিন্না আনছি।’
গতকাল সকাল থেকে দুপুর কুমিল্লা নগরের অন্তত পাঁচটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১০০ টাকার নিচে তেমন কোনো সবজি নেই। সপ্তাহের ব্যবধানে বেশির ভাগ সবজির দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বলা চলে কুমিল্লার কাঁচাবাজারে শাকসবজির দাম নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের নাগালের বাইরে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মো.আছাদুল ইসলাম বলেন, ‘কাঁচা বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। বন্যাসহ বিভিন্ন কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় সবজির দাম এত বেড়েছে বলে বিক্রেতারা দাবি করছেন। এরপরও কেউ দাম বেশি রাখলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
ক্রেতাদের ভাষ্য, অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো শাকসবজির বাজারও এখন শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং না হওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কুমিল্লা নগরের কাঁচাবাজারগুলোয় অধিকাংশ শাকসবজি আসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক–সংলগ্ন জেলার বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার থেকে। নিমসার দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি সবজির বাজার। কুমিল্লা নগর থেকে নিমসারের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। নিমসার থেকে পাইকারি কিনে আনা অনেক সবজি দ্বিগুণ দামেও কুমিল্লা নগরের বাজারগুলোয় খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে। এতে বারোটা বাজছে ক্রেতাদের। বিশেষ করে দিন দিন সবজির বাজার লাগামহীন হয়ে পড়ায় নিম্ন আয় ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই দুর্ভোগে পড়েছেন।
রাজগঞ্জ বাজারে এসে সবজির দাম শুনে অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে নগরের বিষ্ণুপুর এলাকার বাসিন্দা ফজলে রাব্বী বলেন, গত সপ্তাহে শিমের দাম ছিল ১৬০ টাকা আর এখন ৩০০ টাকার ওপরে। গোল বেগুন ছিল সর্বোচ্চ ৮০ টাকা এখন সেই বেগুন ১৬০ টাকা। দুই–তিনটি সবজি ছাড়া এক শ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। ৬০-৭০ টাকার ঢ্যাঁড়স এখন ১২০ টাকা। কয়েক দিন আগেও পুঁইশাকের আঁটি ছিল ৩০ টাকা। এখন বেশির ভাগ দোকানে পুঁইশাকের কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, তবে বাজার নিয়ে সিন্ডিকেট করা ব্যক্তিদের পতন হয়নি।
সরেজমিনে নগরের রাজগঞ্জ, চকবাজার, নিউমার্কেট, মগবাড়ি ও রানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব কাঁচাবাজার সবজির দাম নিয়ন্ত্রণহীন। শিম প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, করলা প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা, পটোল ৮০ থেকে ৯০ টাকা, ধনেপাতা প্রকার ভেদে প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, শসা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল আর ঝিঙা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১২০ টাকায়। বেগুন ১০০ থেকে ১১০ আর গোল বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৮০ টাকা, ফুলকফি প্রতি কেজি ২৪০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। প্রতি পিস লাউ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়।
ক্রেতা ও সবজি বিক্রেতারাও বলছেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় প্রতিটি সবজির দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নগরের মগবাড়ি বাজার এলাকার সবজি ব্যবসায়ী ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘আট বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি, কিন্তু সবজির এত দাম কখনো হতে দেখিনি।’ ওই বাজারের ক্রেতা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা আগে মাছ, মুরগি না কিনে শাকসবজি বেশি কিনত। এখন তো দেখছি মাছ ও মুরগির চেয়ে সবজির দাম বেশি।’
শাকসবজি বাজারের ঊর্ধ্বগতির এ চিত্র নজরে আনা হলে কুমিল্লা জেলার জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রেজা শাহবাজ হাদী জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইন তদারকি এবং পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা বৃহস্পতিবার বেশ কয়েকটি বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছি। আগামী সোমবার থেকে বেশি দামে সবজি বিক্রি করলে জরিমানা করা হবে।’