সবুজে মোড়ানো মেহেরপুর–চুয়াডাঙ্গা সড়ক। সড়কটি চার লেন করতে সড়কের দুই পাশের গাছ কাটা হবে। বুধবার দুপুরে মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গা সড়কের পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে
সবুজে মোড়ানো মেহেরপুর–চুয়াডাঙ্গা সড়ক। সড়কটি চার লেন করতে সড়কের দুই পাশের গাছ কাটা হবে। বুধবার দুপুরে মেহেরপুর- চুয়াডাঙ্গা সড়কের পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে

মেহেরপুরে সড়ক প্রশস্ত করতে দেড় হাজার গাছ হত্যার উদ্যোগ

মেহেরপুর-মুজিবনগর ও মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের দুই পাশে সারি সারি নানা জাতের গাছ। গাছগুলোর বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। সবুজে মোড়ানো সড়ক দুটির একটির প্রস্থ বাড়ানোর ও অন্যটির চার লেন করার উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। সড়ক প্রশস্ত করতে সড়ক দুটির প্রায় দেড় হাজার গাছ কাটার আয়োজন চলছে।

জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, বন বিভাগের সহায়তায় সড়ক দুটির পাশে গাছগুলো লাগিয়েছে জেলা পরিষদ। গাছ কাটতে ইতিমধ্যে জেলা পরিষদকে চিঠি দিয়েছে সওজ। গাছ কাটার অনুমতির জন্য জেলা প্রশাসক ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে প্রাথমিক একটি সমীক্ষা তৈরি করে জমা দিয়েছে জেলা পরিষদ। অনুমোদন পেলে গাছ কাটার দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

পরিবেশবিদদের অভিযোগ, উন্নয়ন ও সড়ক প্রশস্তকরণের দোহাই দিয়ে সড়কের গাছ কেটে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে সরকার। এভাবে গণহারে বৃক্ষনিধনের কারণে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

তবে সওজ বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক প্রশস্ত ও চার লেন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক গাছ কাটা পড়ায় পরিবেশের ক্ষতি হবে ঠিকই। তবে ক্ষতি কমাতে ইতিমধ্যে সড়কের পাশে গাছের চারা লাগানোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সওজ।

সওজ ও জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কের মেহেরপুর পৌর শহর থেকে মুজিবনগর শহীদ স্মৃতি কমপ্লেক্স পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সওজ। সড়কটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সংস্কার করা হয়। অন্যদিকে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের মেহেরপুর সরকারি কলেজ মোড় থেকে আমঝুপি বাজার পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার সড়ক গত বছরের শুরুতে সংস্কার করে সওজ। এখন নতুন করে ওই অংশটি চার লেন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সড়ক প্রশস্তকরণ ও চার লেন করতে সড়ক দুটির দুই পাশে অন্তত দেড় হাজার গাছ কাটার আয়োজন শুরু হয়েছে। এ জন্য সওজের পক্ষ থেকে জেলা পরিষদকে চিঠি দিয়ে গাছ কাটতে বলা হয়েছে।

জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মজিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগের সহায়তায় ওই সড়কগুলোতে গাছ লাগায় জেলা পরিষদ। সওজের সড়ক প্রশস্তকরণের কারণে গাছগুলো কেটে ফেলতে হয়। তিনি বলেন, সড়ক সম্প্রসারণের জন্য ২০১৯ সালে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কের ৬৫টি বড় গাছ কাটা হয়। এরপর ২০২২ সালে মুজিবনগর-দর্শনা সড়কের ১৩৯টি গাছ কাটতে বাধ্য হন তাঁরা। গাছগুলো অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া গত বছর মেহেরপুর থেকে কুষ্টিয়ার ত্রিমোহনী পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণের জন্য ছোট-বড় ৩ হাজার ১৩টি গাছ কাটতে হয়েছে।

গত শনিবার সরেজমিনে কলেজ মোড় থেকে আমঝুপি বাজার পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে নানা ফলদ ও বনজ গাছ। গাছগুলো পুরো সড়কে ছায়া দিয়ে রেখেছে। প্রখর রোদেও সড়কে সূর্যের আলো পড়ছে না। কিছু এলাকায় গাছের নিচে ছোট ছোট চায়ের দোকান দেখা গেল।

মেহেরপুর–চুয়াডাঙ্গা সড়ক চার লেন করতে দুই পাশের গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বুধবার দুপুরে তোলা

পৌর বাস টার্মিনালের সামনে ছোট চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন। সড়কের গাছ কেটে ফেলার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। জানালেন, কয়েক মাস আগে সড়কের পুরোনো গাছ কেটে ফেলা হলো। আবার নতুন করে গাছ কাটবে কেন? এভাবে গাছ কাটলে তো পুরো সড়ক ন্যাড়া হয়ে যাবে।

মুজিবনগর এলাকায় গিয়ে বড় বড় কয়েকটি কড়ইগাছ দেখা গেল। গাছের নিচে অনেক দোকানপাট। স্থানীয় কয়েকজনকে কড়ইগাছের নিচে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। স্থানীয় বাসিন্দা রুবেল মিয়া বলেন, প্রতিবছর সড়ক সংস্কার হচ্ছে। সড়ক ঠিক করার কথা বলে নতুন-পুরোনো গাছগুলো কেটে নিজেদের পকেট ভারী করছে। কেউ প্রতিবাদ করে না। প্রতিবাদ করলে হয়রানির শিকার হতে হয়।

জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস টি হামিম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, বন বিভাগ শুধু গাছ গণনা করে রক্ষণাবেক্ষণ করে। গাছগুলো জেলা পরিষদের। সড়ক সওজের। তারা গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিলে গাছের মূল্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব পড়ে বন বিভাগের ওপর।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গাছ কাটার পরিকল্পনা নেওয়া তাঁদের জন্য দুঃখজনক। সওজ বছর বছর সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্প নেওয়ার কারণে গাছ কাটতে তাদের সহযোগিতা করতে হয়। নতুন করে আবার গাছ লাগানো হবে বলে তিনি জানান।

সওজের মেহেরপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সড়ক প্রশস্ত ও চার লেন করার প্রক্রিয়া চলছে। এতে জেলা পরিষদের লাগানো গাছ কাটা পড়বে। যেহেতু অনেক গাছ কাটা পড়বে, স্বাভাবিকভাবে পরিবেশের ক্ষতি হবে। কিন্তু ভালো খবর হলো ওই সড়কে বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সওজ।

ছহিউদ্দিন ডিগ্রি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মাসুদ রেজা বলেন, এভাবে উন্নয়ন ও সড়ক সম্প্রসারণের নামে গাছ কেটে সরকার পরিবেশের চরম ক্ষতি করছে। এভাবে বৃক্ষনিধনের কারণে জলবায়ুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও বৃষ্টিপাত কমছে। কৃষি হুমকির মুখে পড়ছে। তাই যেকোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে গাছ লাগানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।