খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রায় অবস্থিত ঐতিহাসিক মসজিদকুঁড় মসজিদ
খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রায় অবস্থিত ঐতিহাসিক মসজিদকুঁড় মসজিদ

ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে কয়রার মসজিদকুঁড় মসজিদ

খুলনা জেলা শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার আমাদি ইউনিয়নের সবুজে ঘেরা গ্রাম মসজিদকুঁড়। গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের তীরে ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদকুঁড় মসজিদ। সাত ফুট চওড়া চুন-সুরকির গাঁথুনির নান্দনিক ইটের দেয়াল। দেড় হাজার বর্গফুট আয়তনের মসজিদের ভেতর মাত্র চারটি পাথরের খুঁটির ওপর ৯টি সুদৃশ্য গম্বুজ। পাঁচ শতাধিক বছরের প্রাচীন দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় স্থান এই মসজিদ।

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্তে শত শত মুসল্লি নামাজ আদায় করেন এই মসজিদে। দূর–দূরান্ত থেকে চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর মসজিদটি দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা।

মসজিদের পাশে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, মসজিদটিতে কোনো শিলালিপি না পাওয়ায় নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। তবে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের সঙ্গে এ মসজিদের গঠনপ্রণালি ও স্থাপত্য কৌশলে সাদৃশ্য থাকায় এটি খানজাহান আলীর (রহ.) সময়ে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। মসজিদটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।

লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪১৮ থেকে ১৪৩৩ সালে বাংলার সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ। ওই সময় হজরত খানজাহান আলী (রহ.) দক্ষিণবঙ্গে আসেন। তিনি যশোরের মুড়লী পর্যন্ত পৌঁছে কাফেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একদল সঙ্গী নিয়ে তিনি নিজে বাগেরহাটের দিকে রওনা দেন। আরেক দল খানজাহান আলীর (রহ.) বিশ্বস্ত সহচর বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁ ও তাঁর ছেলে ফতে খাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ দিকে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার আমাদী এলাকায় চলে আসেন। তাঁরা হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) নির্দেশ ও দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ১৪৪৫ সালের দিকে মসজিদকুঁড় মসজিদটি নির্মাণ করেন।

৪৫ শতক জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত বর্গাকার এই মসজিদের প্রতি পাশের দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৭৬ মিটার। ভেতরের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৯ মিটার করে। মসজিদের ভেতরে আছে চারটি ইটের তৈরি স্তম্ভ। প্রতিটি স্তম্ভে দুটি করে পাথর। এই চার স্তম্ভ মসজিদের ভেতরের অংশকে ৯টি সমবর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছে। বর্গক্ষেত্রগুলো ৯টি গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। মাঝখানের গম্বুজটি অন্যগুলোর চেয়ে আকারে বড়।

মসজিদটির পশ্চিম দিকের দেয়াল বাদে বাকি তিন দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশদ্বার আছে। মাঝের প্রবেশদ্বারগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। কেবলামুখী দেয়ালের সঙ্গে আছে অর্ধবৃত্তাকার একটি মিহরাব। মসজিদটি একসময় অনেক নকশা দিয়ে সজ্জিত ছিল। সেগুলোর অনেকটাই খসে পড়েছে। মসজিদের বাইরের দেয়ালের দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর দিকেও পোড়ামাটির চিত্রফলক ছিল। দর্শনার্থীদের কাছে মসজিদকুঁড় মসজিদের প্রধান আকর্ষণ এর অসাধারণ নির্মাণশৈলী।

মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। পাশেই কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ। বাঁধের গা ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদে যাওয়ার সিঁড়ি। সম্প্রতি সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় বর্তমান ইমাম মো. আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, একসময় এখানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শত শত মানুষ বিভিন্ন স্থান থেকে মানত করতে আসতেন। অনেকেই রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভের জন্য, আবার অনেকেই মনোবাসনা পূরণের জন্য আসতেন এখানে। তবে এটি কুসংস্কার ভেবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

মসজিদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা জুলফিকার আলী বলেন, গরমের সময় এই মসজিদের ভেতরটা বেশ ঠান্ডা থাকে।

মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন তত্ত্বাবধায়ক আছেন। তিনি মাঝেমধ্যে আসেন। মসজিদের মূল নকশার ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে এর বাইরে কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে।

প্রচলিত আছে, নির্মাণকালের প্রায় ৩০০ বছর পর জলদস্যুদের অত্যাচারে এ অঞ্চল জনমানবশূন্য হলে মসজিদটি ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়। সে সময় নদের জোয়ার-ভাটার পলিতে ঢাকা পড়ে যায় অনেক স্থাপনা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঘন জঙ্গল কেটে ও মাটি খুঁড়ে মসজিদটি খুঁজে পাওয়া যায়। তখন এর নাম দেওয়া হয় মসজিদকুঁড়। সেই থেকে এই মসজিদের নামেই গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে মসজিদকুঁড় নামে।

কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম আবদুল মালেক বলেন, দেশি-বিদেশি অনেকেই প্রাচীন এ নিদর্শন দেখতে আসেন। পুরো মসজিদকে একটি কমপ্লেক্স হিসেবে গড়তে পারলে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। তখন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনাও বেড়ে যাবে। এ জনপদের মানুষ উপকৃত হবে।