মুন্সিগঞ্জ শহরে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে আজ রোববার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন নিহত হয়েছেন। সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। সকাল পৌনে ১০টার দিকে শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। বিকেল তিনটা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলছিল। গুলি, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
নিহতরা হলেন শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার প্রয়াত কাজী মতিন ফরাজীর ছেলে রিয়াজুল ফরাজী (৩৮), একই এলাকার মো. সজল (৩০) এবং উত্তর ইসলামপুর এলাকার সিরাজ সর্দারের ছেলে ডিপজল (১৯) । তাঁদের মধ্যে রিয়াজুল ও সজল ঘটনাস্থলে এবং হাসপাতাল নেওয়ার সময় ডিপজল মারা যান বলে জানান তাঁর স্বজনেরা।
গতকাল শনিবার সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর অংশ হিসেবে আজ থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সংগঠনটি। আজ সকালে মুন্সিগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় কর্মসূচির ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, রোববার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সকাল পৌনে ১০টার দিকে তাঁরা শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় আসতে থাকেন। এ সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের পেটানো শুরু করেন। ঘটনাস্থলের ঠিক ২০ মিটারের মধ্যে মুন্সিগঞ্জ সদর পুলিশ ফাঁড়ি। সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ।
এ ঘটনার ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার সড়ক দিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় আসতে চাইলে আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতা-কর্মী বন্দুক, ছুরি, লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করেন। পরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বেলা ১১টার দিকে সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি, শিলই ও আধারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অস্ত্র, ককটেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। পরে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ তাঁদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছড়রা গুলি ছোড়ে। এতে শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের উদ্ধার করে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে এবং নৌ ও সড়কপথে ঢাকায় পাঠানো হয়।
মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবু হেনা জামাল আজ দুপুর ২টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাঁদের মধ্যে দুজন মৃত ছিলেন। বেলা ২টা পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানান তিনি। এ ছাড়া গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, সকালে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের মারধর শুরু করেন। পরে তাঁরা একত্র হয়ে মিছিল শুরু করেন। পাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। হঠাৎ করে তাঁদের ওপর হামলা ও গুলি করা হয়। আন্দোলনে দেড় থেকে দুই শতাধিক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কয়েকজন মারা গেছেন। পুলিশের সামনে ঘটনা ঘটলেও পুলিশ আওয়ামী লীগের কাউকে বাধা দেয়নি। উল্টো ছাত্রলীগের গুন্ডাদের ডেকে নিয়ে এসে তাঁদের ওপর হামলা করাচ্ছে। একবার পুলিশ গুলি করে, একবার আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি করে।
এদিকে সংঘর্ষের ছবি ও ভিডিও করার সময় ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে কয়েকজন সাংবাদিককে বেধড়ক পেটান ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা। এতে এনটিভির মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মঈন উদ্দিন সুমন, ডেইলি ট্রাইব্যুনালের ফরহাদ হেসেন, যমুনা টেলিভিশনের ফটোসাংবাদিক হৃদয় হাসান ও সমকালীন কাগজের মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মো. সুমন আহত হন।
সংঘর্ষে আহতদের মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নেওয়ার পথে বাধা দেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা। মুক্তারপুর পেট্রল পাম্প ও মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে আহতদের স্বজনদের মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রল পাম্প এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আম্বুলেন্স দেখলেই পথ আগলে সেগুলো থামাচ্ছেন আওয়ামী লীগের লোকজন। আহত ব্যক্তিদের দেখলেই স্বজনসহ আহতদের পেটাচ্ছেন।
গুলিবিদ্ধ আহতের এক স্বজন মো. রহম বলেন, ‘আহতদের মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিতে দেওয়া হচ্ছে না। সড়কপথে বাধা দিচ্ছে। আমরাসহ অনেকেই ট্রলারে করে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে গেছি। কী ভয়ংকর অবস্থা। মারার পর আহতদের চিকিৎসকের কাছে নিতে দিচ্ছে না।’
সকালে শুরু হওয়া পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। ওই সময় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হামলায় এক পর্যায়ে পিছু হটেন আন্দোলনকারীরা। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীরা সুপার মার্কেটে অবস্থিত জেলা বিএনপির কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালান।